২০৩০ সালের মধ্যে সারাদেশে ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সরকারের লক্ষ্য ছিল শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন ও বিকেন্দ্রিকরণ। পাশাপাশি, এক কোটি কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা। এজন্য ‘বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল আইন, ২০১০’-এর বিধান অনুসারে ২০১০ সালের ৯ নভেম্বর গঠন করা হয় ‘বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ’ (বেজা)। সংস্থাটি ইতোমধ্যে ৯৭টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের অনুমোদন দিয়েছে। একনজরে চিত্রটি দেখে নেওয়া যাক—
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর দেশের সর্বপ্রথম পরিকল্পিত ও স্মার্ট নগর। মোট আয়তন ৩৩ হাজার একর। এটি হবে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ অর্থনৈতিক ও শিল্প জোন। শিল্পনগরীটি প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালে। ২০১৬ সালে ‘মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল’ নামে এর উদ্বোধন হয়।
আরো পড়ুন : কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স জুন ২০২৪ থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর
২০১৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মরণে মিরসরাই-সীতাকুণ্ড ও ফেনীর সোনাগাজীর সীমানাজুড়ে গড়ে উঠা তিনটি অর্থনৈতিক অঞ্চল মিলিয়ে এর নাম রাখা হয় ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর’। শিল্পনগরীর পরিকল্পনাগুলো এরকম—
জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল : ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফরের সময় বাংলাদেশে একটি জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আলোচনা হয়। ২০১৯ সালে বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান সুমিতমো করপোরেশনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করে বেজা। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ২০২২ সালের ৬ ডিসেম্বর। ২০২৪ সালের ২১ মার্চ বহুজাতিক ইলেকট্রনিক্স এবং হোম অ্যাপ্লায়েন্স নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেড প্রথম প্রতিষ্ঠান হিসেবে এই অঞ্চলে পণ্য উৎপাদন শুরু করে।
চীনের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল : ২০১৪ সালের জুনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরকালে চীন চট্টগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের আগ্রহ দেখায়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর একনেকে চীনা বিনিয়োগকারীদের জন্য অর্থনৈতিক ও শিল্পাঞ্চল স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০২২ সালের ১১ আগস্ট স্বাক্ষরিত হয় সমঝোতা স্মারক। এর আলোকে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় চীনা অর্থনৈতিক ও শিল্প অঞ্চল গড়ে তোলার দায়িত্ব দেওয়া হয় চায়না রোড অ্যান্ড ব্রিজ কর্পোরেশনকে। ৭৭৮ একর এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা এই অঞ্চলে থাকছে কেমিক্যাল, অটোমোবাইল অ্যাসেম্বলি, গার্মেন্টস ও ওষুধ কারখানা।
ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরীর সাব জোন-১৯-এ ৮৫৭ একর ভূমির ওপর স্থাপিত হচ্ছে ভারতীয় অর্থনেতিক অঞ্চল। এজন্য ‘মিরসরাইয়ে ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন’ সংক্রান্ত একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। ‘আদানি পোর্টস অ্যান্ড এসইজেড’ ভারত সরকারের নির্বাচিত ডেভেলপার হিসেবে এই অঞ্চলের উন্নয়নে যুক্ত হয়েছে। অন্যদিকে, ভারত সরকারের সঙ্গে ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তির অধীনে বেজা আরেকটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে বাগেরহাটের মোংলা বন্দরের পাশে ১১০ একর জমি বরাদ্দ করেছে।
পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর সেতুটি ঘিরে ঢাকা, বরিশাল ও খুলনা বিভাগে ১৭টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের কাজ এগিয়ে নিতে চাচ্ছে বেজা। বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলায় ২০৫ একর জমি নিয়ে বন্দর-সংলগ্ন এলাকায় স্থাপিত হয়েছে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল। এটি বাস্তবায়িত হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে।
এটির পাশেই ১০৫ একর জমি নিয়ে স্থাপন করা হচ্ছে আরেকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল, যা জি-টু-জি ভিত্তিতে ভারত সরকারের নিযুক্ত ডেভেলপারের সাহায্যে বাস্তবায়িত হবে। ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার মাওয়ার কাছে ৮০০ একর জমি নিয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনে ডিপিপি তৈরি করা হয়েছে।
এছাড়া দুটি করে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপিত হতে যাচ্ছে খুলনা, বরিশাল ও শরীয়তপুরে। একটি করে অঞ্চল হবে মাদারীপুর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, মাগুরা, সাতক্ষীরা, ভোলা ও কুষ্টিয়া জেলায়। এগুলো বাস্তবায়িত হলে দক্ষিণ- পশ্চিমাঞ্চলের পরিকল্পিত শিল্পায়ন ত্বরান্বিত হবে।
দেশি-বিদেশি পর্যটক আকর্ষণ করতে বেজা বিভিন্ন স্থানে ৩টি ট্যুরিজম পার্কের পরিকল্পনা করেছে। এগুলো হলো : মহেশখালী উপজেলায় সোনাদিয়া ইকো-ট্যুরিজম পার্ক এবং টেকনাফ উপজেলায় নাফ ট্যুরিজম পার্ক ও সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক। টেকনাফে সমুদ্রের পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠেছে দেশের প্রথম বিশেষায়িত ট্যুরিজম পার্ক সাবরাং। এখানে ৭টি প্রতিষ্ঠান ৯৪.৪৪ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে।
এই পার্কে থাকছে ইকো-ট্যুরিজম, মেরিন অ্যাকুয়ারিয়াম, সি-ক্রুজ, বিদেশি পর্যটকদের জন্য সংরক্ষিত এলাকা, সেন্টমার্টিনে ভ্রমণের বিশেষ ব্যবস্থা, ভাসমান জেটি, শিশু পার্ক, ইকো-কটেজ, ওশেনেরিয়াম, আন্ডারওয়াটার রেস্টুরেন্ট, ভাসমান রেস্টুরেন্টসহ নানা বিনোদনের সুবিধা। কর্তৃপক্ষের প্রত্যাশা, এই কেন্দ্রটি বাস্তবায়িত হলে ১১ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
অন্যদিকে, মিয়ানমারের আপত্তির মুখে ২০২৩ সালে বন্ধ হয়ে গেছে নাফ ট্যুরিজম পার্কের উন্নয়নকাজ। পরিশেষে বলা যায়, পরিকল্পিত শিল্পায়ন, বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি ও কর্মসংস্থানের লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়িত হলে ২০৪১ সালের মধ্যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভব হবে।
Leave a Comment