আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সারাবিশ্বে অপ্রত্যাশিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ হানা দিচ্ছে। নানান দেশে খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, দাবানল ও হিট ডােমসহ এসব দুর্যোগের ধরন ও ভয়াবহতা পালটেছে।
খরা
খরা বা Drought একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। দীর্ঘকাল ধরে শুষ্ক আবহাওয়া, অপর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত ও ভূ-পৃষ্ঠ বা ভূগর্ভস্থ পানি সরবরাহে দীর্ঘস্থায়ী ঘাটতির কারণে খরা হয়। খরার সময় খরা পীড়িত অঞ্চল তপ্ত হয়ে ওঠে এবং কুয়া, খাল, বিল শুকিয়ে যাওয়ায় ব্যবহার্য পানির অভাব ঘটে।
খেতের ফসল শুকিয়ে শস্য বিপর্যয় ঘটে। আবহাওয়া বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে খরাকে তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায় স্থায়ী খরা, যা শুষ্ক জলবায়ুর কারণে ঘটে; মৌসুমি খরা, যা বর্ষা ও শীত মৌসুমের সাধারণ নিয়মের ব্যত্যয় থেকে ঘটে এবং আপকালীন খরা, যা অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের কারণে ঘটে। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি খরা ঝুঁকিতে রয়েছে আফ্রিকা মহাদেশের সােমালিয়া, জিম্বাবুয়ে ও জিবুতি ।
ভারত বাংলাদেশের উজান এলাকায় ফারাক্কা বাধসহ বিভিন্নভাবে পানি প্রত্যাহারের কারণে অধিকাংশ নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে প্রায়শই খরা দেখা দেয়।
তাপপ্রবাহ
কোনাে জায়গার দৈনিক যে গড় তাপমাত্রা তা থেকে তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি বেড়ে গেলে এবং পরপর ৫ দিন তা চলমান থাকলে তাকে Heat wave বা তাপপ্রবাহ বলা হয়। কোনাে এলাকায় যদি তাপমাত্রা ৪০-৪২° সেলসিয়াস থাকে তাহলে তাকে তীব্র তাপপ্রবাহ বলে।
এই বিভাগ থেকে আরো পড়ুন
কোনাে স্থানে তাপপ্রবাহ প্রাকৃতিক নিয়মে শুরু হলেও তাপপ্রবাহের তীব্রতা কম বা বেশি হওয়ার ওপর সেই স্থানের মানুষের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। একই তাপপ্রবাহ ঢাকা শহরের পাশে অবস্থিত আড়িয়াল বিল এলাকার কিংবা পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার মানুষের জন্য যতটুকু অস্বস্তি সৃষ্টি করবে, তা অপেক্ষা অনেক বেশি অস্বস্তি সৃষ্টি করবে ঢাকা শহরের মানুষের জন্য। যে শহরে খােলা জায়গা ও গাছপালা যত বেশি থাকবে, সেই এলাকার মানুষ তাপপ্রবাহের ক্ষতিকর প্রভাব তত কম অনুভব করবে।
তাপ গম্বুজ
সমুদ্রের গরম হাওয়া যখন বায়ুমণ্ডলের ওপর দিক থেকে চেপে ভূপৃষ্ঠের নির্দিষ্ট অংশে ঢাকনা বা গম্বুজের মতাে জমা হয়ে যায়, তাকে Heat dome বা তাপ গম্বুজ বলে। এক্ষেত্রে ভূপৃষ্ঠের ঐ স্থানের গরম হাওয়া বের হতে পারে না, ফলে চলতে থাকে তাপপ্রবাহ। আর সেই কারণেই অত্যধিক গরমে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান অনেকেই।
Heat dome সাধারণত এক সপ্তাহের মতাে স্থায়ী হয়। তারপর আচমকাই গরম বায় বেরিয়ে গেলে তাপমাত্রা ১৫° সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে আসতে পারে। আর সেই ধাক্কা সহ্য করতে না পেরে আরও অনেক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। সাধারণত প্রশান্ত মহাসাগরের গরম বায়ু Heat dome তৈরি করে। তাই যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ অনেক দেশ এর বিরূপ প্রভাবের শিকার হয়।
দাবানল
দাবানল বা Wildfire হচ্ছে বনভূমি বা বনাঞ্চলে সংঘটিত অনিয়ন্ত্রিত আগুন। উত্তপ্ত বা শুষ্ক আবহাওয়ায় বনাঞ্চল সমৃদ্ধ যেকোনাে স্থানেই দাবানল দেখা দিতে পারে। প্রাকৃতিকভাবে সাধারণত দুটি উপায়ে দাবানল শুরু হতে পারে। প্রথমত, যদি কোনাে শুষ্ক বনভূমির ওপর বজ্রপাত হয়।
দ্বিতীয়ত, কোনাে আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত লাভা অথবা বিভিন্ন পদার্থের জ্বলন্ত টুকরা থেকে। এরপর সেটি ছড়িয়ে পড়তে পারে। এছাড়া মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণেও দাবানল সৃষ্টি হয়। তবে সাম্প্রতিককালে মানবসৃষ্ট কারণেই দাবানল বেশি ঘটে থাকে। কোনাে অঞ্চলে দাবানল দেখা দিলে বাধাগ্রস্ত হয় পরিবহন, যােগাযােগ, জ্বালানি, গ্যাস ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থা।
শৈত্যপ্রবাহ
শৈত্যপ্রবাহ বা Cold flow বলতে কোনাে স্থানের বায়ুর তাপমাত্রার নিম্নগামীতাকে নির্দেশ করে থাকে। ২৪ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে বাতাসের তাপমাত্রা দ্রুততার সাথে নেমে যাওয়াকেই শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়। শীতকালে সূর্য বিষুব রেখার দক্ষিণে চলে যায়। আমাদের দেশ বিষুব রেখার উত্তরে। তখন দিন ছােট, রাত বড় হয়।
আমাদের দেশে যখন শীতকাল, পৃথিবীর দক্ষিণ গােলার্ধের দেশগুলাে যেমন : অস্ট্রেলিয়ায় তখন গ্রীষ্মকাল। এ সময় দক্ষিণ গােলার্ধে বাতাস উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ফলে উত্তর গােলার্ধ থেকে ঠান্ডা বাতাস দক্ষিণে প্রবাহিত হয়। আমাদের দেশের উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা। সেখান থেকে ঠান্ডা বাতাসের প্রবল প্রবাহ আমাদের দেশের ওপর দিয়ে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়। এটাই শৈত্যপ্রবাহ।
অতিবৃষ্টি
ঘণ্টায় ১০ মিলিমিটার থেকে ৫০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হলে তাকে Heavy rain বা অতিবৃষ্টি বলে। বৃষ্টিপাত মাপার ক্ষেত্রে বৃষ্টির ধারার্কে মিলিলিটারে পরিমাপ করা হয়। এক্ষেত্রে ঘণ্টায় ২.৫ মিলিমিটারের কম বৃষ্টিপাতকে হালকা, ২.৫ মিলিমিটার থেকে ১০মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাতকে ভারী এবং ৫০ মিলিমিটারের অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতকে চরম বৃষ্টি বলা হয়।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভারত মহাসাগর এবং বঙ্গোপসাগরে গত কয়েক বছর ধরে তাপমাত্রা অত্যধিক বেড়েছে। ফলে বায়ুমণ্ডলে বেশি জলীয় বাষ্প যাচ্ছে এবং বেশি বৃষ্টিপাত হচ্ছে।