আমাদের সকল পোস্ট ও ভিডিও হোয়াটসঅ্যাপে পেতে ফলো করুন :

Click Here
বাংলা রচনা সম্ভার

বাংলা রচনা অপসংস্কৃতি ও বর্তমান যুবসমাজ

সংস্কৃতি সম্পর্কে আলােচনা করতে গিয়ে মােতাহের হােসেন চৌধুরী বলেছেন- “সংস্কৃতি মানে। সুন্দরভাবে, বিচিত্রভাবে, মহত্তাবে বাঁচা” অর্থাৎ বেঁচে থাকার জন্য মানুষের নৈমিত্তিক প্রচেষ্টাই সংস্কৃতি, আর অপসংস্কৃতি হলাে এর বিপরীত। আত্মার মৃত্যু ঘটিয়ে অসুন্দরের উপাসনা করে, অকল্যাণের হাত ধরে বেঁচে থাকাই অপসংস্কৃতি। অপসংস্কৃতি মানুষকে কলুষিত করে এবং জীবনের সৌন্দর্যের বিকাশকে স্তব্ধ। করে দিয়ে শ্রীহীনতার দিকে ঠেলে দেয়।

জীবনের সাথে সংস্কৃতির সম্পর্ক :

জীবনের সাথে সংস্কৃতির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। সমাজে বসবাসরত মানুষের প্রত্যেকটি কার্যকলাপই তাদের সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান। কোনাে সমাজই তাদের সংস্কৃতিকে অস্বীকার করতে পারে না। মূলত সংস্কৃতি এবং জীবন একে অপরের পরিপূরক।

অপসংস্কৃতির উৎস :

উনিশ শতকের বাংলায় পাশ্চাত্য সংস্কৃতি উদ্দাম ভােগ-বিলাসিতা ও উচ্ছংখলতার জন্ম দেয়। নতুন সংস্কৃতির উন্মত্ততায় সে সময়ে যে অনাচার ও উচ্ছংখলতা দেখা দিয়েছিল সেগুলােকে বর্জন করে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সদর্থক ইতিবাচক দিকগুলাে গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়েছিল সমাজ-সংস্কারক বাঙালি মনীষীরা। বর্তমানে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার অবাধ সুযােগে আমাদের জাতীয় জীবনে অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে।

এই বিভাগ থেকে আরো পড়ুন

পাশ্চাত্য যুবসমাজ যে মাদক নেশা ও অবক্ষয়ে আক্রান্ত, আকাশ-সংস্কৃতির মাধ্যমে তা ক্রমবিস্তার লাভ করছে আমাদের তরুণ সমাজে। অসংযত পাশ্চাত্য মানসিকতা, উগ্র বিদেশিয়ানা ও ভােগপ্রবণ স্থূলতা আজ আমাদের সংস্কৃতির মূলধারাকে গ্রাস করতে বসেছে। বৈদেশিক সংস্কৃতির নির্বিকার গ্রহণ আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির জন্য এখন হুমকিস্বরূপ।

জাতীয় জীবনে অপসংস্কৃতির অশনি সংকেত :

বাংলাদেশে জাতীয় জীবনে অপসংস্কৃতির প্রবল প্রতাপ লক্ষনীয়। অসুস্থ প্রতিযােগিতার মাধ্যমে ব্যক্তিগত লােভ-লালসা চরিতার্থ করার এক উদ্ভট জোয়ার চলছে এ দেশে। বিশেষত এ দেশের তরুণ সমাজ আজ দিকভ্রান্ত, দিশেহারা। তাদের বেঁচে থাকার সাথে নীতির সম্পর্ক নেই। এই বােধ থেকেই অপসংস্কৃতির জন্ম হয়। সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার প্রচেষ্টা এখন হাস্যকর দুর্নীতি এখন সামাজিকভাবে স্বীকৃত।

আর এখন অনৈতিকতার সূত্রপাত হচ্ছে মানুষের অসৎ জীবিকার্জনের হাত ধরে। সত্তাবে যে জীবিকার্জন না করে তার পক্ষে অপসংস্কৃতির দাসত্ব ছাড়া উপায় নেই। প্রতিদিনের সংবাদপত্র আমাদের সামনে যে চালচিত্র তুলে ধরে, তাতে অপসংস্কৃতির আগ্রাসন অতি স্পষ্ট। অশ্লীলতা, নােংরামি, খুন, ছিনতাই, প্রতারণা- সবই অপসংস্কৃতির ভিন্ন ভিন্ন নাম। আমাদের সমাজ আজ এসবেরই দাসত্ব করে চলেছে।

অপসংস্কৃতি ও আমাদের যুবসমাজ :

সমাজবিজ্ঞানী E.B Taylor বলেন- “Calture perrersion might lead the youth gearation.” আজকের তরুণেরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। কিন্তু অপসংস্কৃতি তাদের জীবনকে ধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। যুবসমাজ চ্যুত তারা। অসুন্দর ও কলুষিত সংস্কৃতি তথা অপসংস্কৃতির শিকার। যুবসমাজের একটা বড় অংশকে সুকৌশলে করা হয়েছে আদর্শভ্রষ্ট। সুন্দর জীবনের পথ থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অন্ধকার জীবনের পথে।

তারা তলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার জগতে, অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে মাদকের নেশায়। বিপুল সংখ্যক তরুণের হাতে তুলে দেয়া | হয়েছে অস্ত্র, জড়িয়ে ফেলা হয়েছে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসমূলক কর্মকান্ডে। তারা লিপ্ত হচ্ছে অসামাজিক কাজে। হিংসাশ্রয়ী-অশ্লীল চলচ্চিত্র, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পরিপন্থী বিকৃত রুচির নাচ-গান, রুচিগহিত পােশাকপরিচ্ছদের প্রতি তাদেরকে আকৃষ্ট ও অনুরক্ত করার গভীর নীলনকশা ধীরে ধীরে কার্যকর হচ্ছে।

পােশাক-পরিচ্ছদের উপর প্রভাব :

পােশাক-পরিচ্ছদে আমাদের নিজস্ব একটি ঐতিহ্য ছিল। বিদেশি সংস্কৃতির ব্যাপক প্রসার ও চর্চা আমাদের ঐতিহ্যবাহী পােশাক-পরিচ্ছদে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। জিন্স, টি-শার্ট, স্কার্ট এখন আমাদের ছেলেমেয়েদের খুবই প্রিয়। শাড়ি-লুঙ্গি কিংবা পাজমা-পাঞ্জাবি এখন আর তাদের কাছে। তেমন গুরুত্ব পায় না।

আমাদের মেয়েদের অনেকেই স্বল্পবসনকে আধুনিক জীবনের নমুনা বলে ভুল করে।পশ্চিমা সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণের ফলে তারা একদিকে যেমন আধুনিক জীবনের ধারাকে ধরতে পারে না। তেমনি দেশীয় সংস্কৃতির সাথেও নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে না। ফলে তারা একটি দোদুল্যমান অবস্থায় পতিত হয় অবশেষে জীবন হয়ে পড়ে লক্ষ্যহীন ও হতাশাপূর্ণ।

আরো গুরুত্বপূর্ণ কিছু বাংলা রচনা পড়ুন :

খাদ্যাভ্যাসের উপর প্রভাব :

বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রভাবে যুবসমাজে খাদ্যাভ্যাসে এসেছে বিরাট পরিবর্তন। কোনাে খাবারের পুষ্টিমান বিবেচনা না করে টেলিভিশন চ্যানেলে খাবারের বিজ্ঞাপন দেখে আমাদের নতুন প্রজন্ম তাতে আকৃষ্ট হচ্ছে। আমাদের সংস্কৃতির নতুন সংযােজন হচ্ছে ফাস্টফুড সংস্কৃতি। বর্তমানে তরুণতরুণীসহ শিশু-কিশাের এমনকি বয়স্কদের মাঝেও এ সংস্কৃতি চর্চা হচ্ছে। যা বাঙালির ঐতিহ্যবাহী নিজস্ব খাবারগুলােকে ক্রমান্বয়ে অস্বীকার করার প্রবণতা তৈরি করছে।

ভাষা ও সংলাপের উপর প্রভাব :

বিশ্বায়নের আর একটি প্রত্যক্ষ ও বাহ্যিক প্রভাব আমাদের তরুণ প্রজন্মের কথাবার্তার পরিবর্তন। বর্তমান শিশুরা বাবা-মাকে বাংলা ভাষায় সম্বােধন না করে বিদেশি ভাষা বিশেষত ইংরেজিতে পাপা, মাম্মি বা মম ডাকতে আগ্রহী। কথায় কথায় তারা অন্য ভাষার শব্দ ব্যবহার করে। বাংলা ইংরেজি, হিন্দি একসাথে মিলিয়ে পরস্পরের সাথে কথা বলে, একে তারা আধুনিকতা মনে করে। তাছাড়া বাংলা শব্দের বিকৃতি এখন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হচ্ছে।

ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার উপর প্রভাব :

বিদেশি সংস্কৃতি আমাদের জাতীয় জীবনে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিককে চরমভাবে আঘাত করছে, সেটি হলাে আমাদের ধর্মীয় জীবনবােধ ও নৈতিক শিক্ষা। পশ্চিমা ভােগবাদী সংস্কৃতির ব্যাপক প্রচারের ফলে আমাদের যুবসমাজে ধর্মনিষ্ঠা এবং নৈতিকতা বােধ ক্রমহ্রাসমান। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা আর অ্যালকোহলিক সংস্কৃতি আমাদের সংস্কৃতির পরিপন্থী। সুখী সুন্দর ও শান্তিময় জীবনের জন্য এসব কিছুর চেয়ে ধর্মীয় জীবনের নীতি অনুসরণ খুবই জরুরি। বিদেশি সংস্কৃতির আমাদের সামাজিক মূল্যবােধের অবক্ষয়ে প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে।

অপসংস্কৃতি রােধের উপায় :

পৃথিবীর বাসিন্দা হয়ে বিশ্ব সম্রাজ্যের বাইরে যাওয়ার কোনাে উপায় আমাদের নেই। তাই এর মধ্যে থেকেই নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আর স্বার্থকে বাঁচিয়ে রেখে চলতে হবে। যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে যুব সমাজের এই বিপথগামিতা, সেই পরিবেশের আমূল সংস্কার অপরিহার্য। এ ব্যাপারে সকল শ্রেণির মানুষকে সচেতন হতে হবে। নিষিদ্ধ করতে হবে অপসংস্কৃতির বেসাতি। তাদের। অনুপ্রাণিত করতে হবে নতুন মূল্যবােধে।

সুযােগ দিতে হবে আত্মবিকাশের। মনে রাখতে হবে, আদর্শভ্রষ্টতাই এ কালের যুব সমাজের একমাত্র চিত্র নয়। এক শ্রেণির যুবসমাজ বেশ সক্রিয়, সজাগ ও আদর্শবাদী। সামাজিক অবিচার, অর্থনৈতিক শােষণ, রাজনৈতিক শঠতা সবকিছুর বিরুদ্ধেই এরা সােচ্চার। তাই আজ যারা অপসংস্কৃতির বেড়াজালে আটকে গিয়ে অলস তন্দ্রায় আচ্ছন্ন, সঠিক পথনির্দেশনা পেলে এই যুবসমাজই আবার উজ্জীবিত হবে দুর্বার প্রাণশক্তিতে। ফিরে পাবে তাদের হারানাে শুভবুদ্ধি।

যুবসমাজকে অপসংস্কৃতি থেকে রক্ষা করতে হলে বিদেশি সংস্কৃতির দরজা বন্ধ করে নিজেদেরকে আরও বেশি প্রতিযােগিতার উপযােগী করে তুলতে হবে। দেশীয় সংস্কৃতির লালন করতে হবে। আর বিদেশি সংস্কৃতির মােকাবেলায় টিকে থাকার জন্য দেশীয় সংস্কৃতিকে করে তুলতে হবে যুগােপযােগী। বিদেশি সংস্কৃতি অনুসরণ ও অনুকরণের ক্ষেত্রে আরও বেশি সজাগ হতে হবে। বিজাতীয় করুচিপূর্ণ সংস্কৃতি বন্ধের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে। বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রকাশই আভিজাত্যের পরিচায়ক তরুণদের এ ধারণা ঘােচাতে হবে।

উপসংহার :

সুন্দরভাবে বাঁচতে হলে যুবসমাজকে অপসংস্কৃতির করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করা ছাড়া কোনাে বিকল্প নেই। যুবশক্তির পুনরুজ্জীবনে চাই শুভ সুন্দর জীবনের নবতর দীক্ষা। মনুষ্যত্বের বিকাশ ও মানবপ্রেমে ব্ৰতী করে যুবসমাজকে পরিচালিত করতে হবে সামাজিক অন্যায়-অবিচার, অর্থনৈতিক শােষণ, রাজনৈতিক শঠতার বিরুদ্ধে।

Md. Mahabub Alam

I am a committed educator, blogger and YouTuber and I am striving to achieve extraordinary success in my chosen field. After completing Masters in Anthropology from Jagannath University, I am working as Chief Accounts Officer in a national newspaper of the country. I really want your prayers and love.
Back to top button