রাষ্ট্র কাকে বলে? এটি জানা আমাদের সকলের প্রয়োজন। রাষ্ট্র একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। বিশ্বের মানুষ কোনাে না কোনাে রাষ্ট্রে বসবাস করে। আমাদের এই পৃথিবীতে ছােট বড় মিলিয়ে প্রায় ২০০ টি রাষ্ট্র আছে । প্রতিটি রাষ্ট্রেরই আছে নির্দিষ্ট ভূখণ্ড এবং জনসংখ্যা। এ ছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য আরও আছে সরকার এবং সার্বভৌমত্ব। মূলত এগুলাে ছাড়া কোনাে রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে না। অধ্যাপক গার্নার বলেন, সুনির্দিষ্ট ভূখণ্ডে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী, সুসংগঠিত সরকারের প্রতি স্বভাবজাতভাবে আনুগত্যশীল, বহিঃশত্রুর নিয়ন্ত্রণ হতে মুক্ত স্বাধীন জনসমষ্টিকে রাষ্ট্র বলে। এ সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে রাষ্ট্রের চারটি উপাদান পাওয়া যায় । যথা-
১। জনসমষ্টি,
২। নির্দিষ্ট ভূখণ্ড,
৩। সরকার ও
৪। সার্বভৌমত্ব ।
১. জনসমষ্টি : রাষ্ট্র গঠনের অপরিহার্য উপাদান জনসমষ্টি । কোনাে ভূখণ্ডে একটি জনগােষ্ঠী স্থায়ীভাবে বসবাস করলেই রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে। তবে একটি রাষ্ট্র গঠনের জন্য কী পরিমাণ জনসমষ্টি প্রয়ােজন, এর কোনাে সুনির্দিষ্ট নিয়ম নেই। যেমন- বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৫ কোটি, ভারতের জনসংখ্যা প্রায় ১২১ কোটি (২০১১), ব্রুনাইয়ে প্রায় দুই লক্ষ। তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, একটি রাষ্ট্রের সম্পদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ জনসংখ্যা থাকা বাঞ্ছনীয়।
২. নির্দিষ্ট ভূখণ্ড : রাষ্ট্র গঠনের জন্য নির্দিষ্ট ভূখণ্ড আবশ্যক। ভূখণ্ড বলতে একটি রাষ্ট্রের স্থলভাগ, জলভাগ ও আকাশসীমাকে বােঝায়। রাষ্ট্রের ভূখণ্ড ছােট বা বড় হতে পারে। যেমন- বাংলাদেশের ক্ষেত্রফল ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিলােমিটার। তবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিক স্থল সীমানা চুক্তি অনুযায়ী ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই দু’দেশের মধ্যে পারস্পরিক ছিটমহল বিনিময়ের ফলে বাংলাদেশের মােট ভূখন্ডে ১০,০৪১.২৫ একর জমি যােগ হয়েছে। এছাড়া বঙ্গোপসাগরে মিয়ানমার ও ভারতের ৯ সাথে আন্তর্জাতিক আদালতে সমুদ্রসীমা মামলার রায় বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার আয়তন বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে সমুদ্রে ১,১১,৮১৩ বর্গ কি.মি. সমুদ্র অঞ্চলে বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গণচীন, ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা প্রভৃতি রাষ্ট্রের ক্ষেত্রফল বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বড়।
৩. সরকার : রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সরকার। সরকার ছাড়া রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে না। রাষ্ট্রের যাবতীয় কার্যাবলি সরকারের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। সরকার গঠিত হয় তিনটি বিভাগ নিয়ে। যথাআইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। সকল রাষ্ট্রের সরকারের গঠন একই রকম হলেও রাষ্ট্রভেদে সরকারের রূপ ভিন্ন ভিন্ন। যেমন- বাংলাদেশে সংসদীয় সরকার, আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার। রাষ্ট্রের যাবতীয় শাসনকাজ সরকারই পরিচালনা করে থাকে।
৪. সার্বভৌমত্ব : সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্র গঠনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। এটি রাষ্ট্রের চরম, পরম ও সর্বোচ্চ ক্ষমতা। এর দুটি দিক রয়েছে, যথা- অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সার্বভৌমত্ব । অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্বের সাহায্যে রাষ্ট্র দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন আদেশ-নির্দেশ জারির মাধ্যমে ব্যক্তি ও সংস্থার উপর কর্তৃত্ব করে। অন্যদিকে, বাহ্যিক সার্বভৌমত্বের মাধ্যমে রাষ্ট্র বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণ থেকে দেশকে মুক্ত রাখে।
রাষ্ট্র কখন ও কীভাবে উৎপত্তি লাভ করেছে তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা অতীত ইতিহাস ও রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে কতগুলাে মতবাদ প্রদান করেছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলাে-
১। ঐশী মতবাদ,
২। বল বা শক্তি প্রয়োেগ মতবাদ,
৩। সামাজিক চুক্তি মতবাদ ও
৪। ঐতিহাসিক বা বিবর্তনমূলক মতবাদ।
এটি রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে সবচেয়ে পুরাতন মতবাদ। এ মতবাদে বলা হয়- বিধাতা বা স্রষ্টা স্বয়ং রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছেন এবং রাষ্ট্রকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য তিনি শাসক প্রেরণ করেছেন। শাসক তাঁর প্রতিনিধি এবং তিনি তার কাজের জন্য একমাত্র স্রষ্টা বা বিধাতার নিকট দায়ী, জনগণের নিকট নয়। শাসক যেহেতু স্রষ্টার নির্দেশে কাজ করে, সেহেতু শাসকের আদেশ অমান্য করার অর্থ বিধাতার নির্দেশ অমান্য করা। এ মতবাদ অনুসারে শাসক একাধারে যেমন রাষ্ট্রপ্রধান এবং অন্যদিকে তিনিই আবার ধর্মীয় প্রধান। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এ মতবাদকে বিপদজনক, অগণতান্ত্রিক ও অযৌক্তিক বলে সমালােচনা করেন। তাদের মতে, যেখানে জনগণের নিকট শাসক দায়ী থাকে না, সেখানে স্বৈরশাসন সৃষ্টি হয়। এ মতবাদকে বিধাতার সৃষ্টিমূলক মতবাদও বলা হয়।
এ মতবাদের মূল বক্তব্য হলাে- বল বা শক্তি প্রয়ােগের মাধ্যমে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে এবং শক্তির জোরে রাষ্ট্র টিকে আছে। এ মতবাদে বলা হয়, সমাজের বলশালী ব্যক্তিরা যুদ্ধ-বিগ্রহ বা বল প্রয়ােগের মাধ্যমে দুর্বলের উপর নিজেদের আধিপত্য স্থাপনের মাধ্যমে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে এবং শাসনকার্য পরিচালনা করে। এ মতবাদে আরও বলা হয়, সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত এভাবেই যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমে রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। সমালােচকরা এ মতবাদকে অযৌক্তিক, ভ্রান্ত ও ক্ষতিকর বলে আখ্যায়িত করেছেন। তারা বলেন, শক্তির মাধ্যমেই যদি রাষ্ট্র টিকে থাকত তাহলে শক্তিশালী রাষ্ট্রের পাশাপাশি সামরিক দিক থেকে দুর্বল রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারত না। আসলে শক্তির জোরে নয় বরং
সম্মতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র গড়ে উঠে এবং টিকে থাকে।
এ মতবাদের মূলকথা হলাে- সমাজে বসবাসকারী জনগণের পারস্পরিক চুক্তির ফলে রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। ব্রিটিশ রাষ্ট্র দার্শনিক টমাস হবস্ ও জন লক এবং ফরাসি দার্শনিক জ্যা জ্যাক রুশাে সামাজিক চুক্তি মতবাদের প্রবর্তক ছিলেন। এ মতবাদ অনুযায়ী, রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বে মানুষ প্রকৃতির রাজ্যে বসবাস করত। তারা প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলত এবং প্রাকৃতিক সুযােগ-সুবিধা ভােগ করত। কিন্তু প্রকৃতির রাজ্যে আইন অমান্য করলে শাস্তি দেয়ার কোনাে কর্তৃপক্ষ ছিল না। ফলে সামাজিক জীবনে অরাজকতা ও বিশৃংখলা সৃষ্টি হয়। মানুষ। হয়ে উঠে স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক। দুর্বলের উপর চলে সবলের অত্যাচার। এ কারণে মানুষের জীবন কষ্টকর ও দুর্বিষহ হয়ে উঠে। এ ছাড়া প্রকৃতির রাজ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যক্তিগত সম্পত্তির আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়ােজনীয়তা দেখা দেয়। প্রকৃতির রাজ্যের এ অরাজকতাপূর্ণ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মানুষ নিজেদের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র সৃষ্টি করে এবং নিরাপত্তার বিনিময়ে নিজেদের উপর শাসন করার জন্য স্থায়ীভাবে শাসকের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করে ।
এ মতবাদের মূল বক্তব্য হলাে- রাষ্ট্র কোনাে একটি বিশেষ কারণে হঠাৎ করে সৃষ্টি হয়নি। দীর্ঘদিনের বিবর্তনের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন শক্তি ও উপাদান ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে হতে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে। যেসব উপাদানের কার্যকারিতার ফলে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে, সেগুলাে হলােসংস্কৃতির বন্ধন, রক্তের বন্ধন, ধর্মের বন্ধন, যুদ্ধবিগ্রহ, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চেতনা ও কার্যকলাপ। ঐতিহাসিক বা বিবর্তনমূলক মতবাদ সম্পর্কে ড. গার্নার বলেন, রাষ্ট্র বিধাতার সৃষ্টি নয়, বল প্রয়ােগের মাধ্যমেও সৃষ্টি হয়নি বরং ঐতিহাসিক ক্রমবিবর্তনের ফলে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে। রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত বিভিন্ন মতবাদের মধ্যে ঐতিহাসিক বা বিবর্তনমূলক মতবাদ সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত ও গ্রহণযােগ্য মতবাদ। এ মতবাদে রাষ্ট্রের উৎপত্তির সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। আসলে বর্তমানের রাষ্ট্র বহুযুগের বিবর্তনের ফল।
Recent Comments