মৌর্যযুগের পর নানা কারণে গুপ্তযুগ প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে ভারতবর্ষ বহুখণ্ডে বিভক্ত ও বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির অবসান ঘটিয়ে গুপ্ত বংশ ভারতবর্ষে আবারও রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে। ভৌগােলিক আয়তনের দিক থেকে মৌর্য সাম্রাজ্যের তুলনায় গুপ্ত সাম্রাজ্য ছােট হলেও অনুপাতে দীর্ঘস্থায়ী ছিল। গুপ্ত যুগে শিল্পসাহিত্য ও বিজ্ঞানের এক অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটে।
মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতের রাজনীতিতে শুরু হয় বিচ্ছিন্নতা, আঞ্চলিকতার প্রকাশ ও বৈদেশিক শক্তির অনুপ্রবেশ। গুপ্ত সাম্রাজ্যের উত্থান ছিল তার বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিবাদ। কুষাণােত্তর যুগে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের উদ্ভব দেখা যায়। গাঙ্গেয় উপত্যকায় শক্তি শূন্যতা এবং গঙ্গা-যমুনা উপত্যকার উর্বরভূমির ওপর ভিত্তি করেই গুপ্ত সাম্রাজ্যের উদ্ভব ঘটে।
শিলালিপির সাক্ষ্য অনুসারে গুপ্ত বংশের প্রতিষ্ঠাতার নাম শ্রীগুপ্ত। শ্রীগুপ্ত বরেন্দ্র অথবা তার পার্শ্ববর্তী প্রদেশে রাজত্ব করতেন। মগধে তার রাজধানী ছিল। তিনি শুধু ‘মহারাজ’ উপাধি ব্যবহার করতেন। রাজা শ্রীগুপ্তের মৃত্যুর পর, তার পুত্র ঘটোৎকচ এ ক্ষুদ্র রাজ্যের রাজা হন। পিতা পুত্রের কেউ-ই বড় মাপের রাজা ছিলেন না; কিন্তু ঘটোকচের পুত্র প্রথম চন্দ্রগুপ্ত (৩২০-৩৪০ খ্রি.) সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রতাপশালী রাজা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
প্রথম চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালেই গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রসার ঘটে এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে গুপ্তদের বিকাশ লক্ষ করা যায়। প্রথম চন্দ্রগুপ্ত ‘লিচ্ছবি’ রাজকন্যাকে বিয়ে করেন। এই বৈবাহিক সম্পর্ক গুপ্তদের মর্যাদাকে বহুগুণ বৃদ্ধি করে। মৃত্যুর পূর্বে প্রথম চন্দ্রগুপ্ত তার পুত্র সমুদ্রগুপ্তকে উত্তরাধিকারী মনােনীত করে যান।
মহারাজ শ্রীগুপ্ত
মহারাজ ঘটোৎকচ গুপ্ত
মহারাজাধিরাজ প্রথম চন্দ্রগুপ্ত
সমুদ্রগুপ্ত
রামগুপ্ত
চন্দ্রগুপ্ত (দ্বিতীয়)
কুমারগুপ্ত
স্কন্দগুপ্ত
পুরুগুপ্ত
বুধগুপ্ত
নরসিংহ গুপ্ত
তৃতীয় কুমার গুপ্ত
বিষ্ণুগুপ্ত
মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর সমুদ্রগুপ্তই সমগ্র ভারতে এক সার্বভৌম রাজশক্তি স্থাপন করেন। তার সামরিক অভিযানের ব্যাপকতা এবং রাষ্ট্রীয় আধিপত্যের বিস্তৃতি লক্ষ করে স্মিথ তাকে ‘ভারতের নেপােলিয়ন’ বলে অভিহিত করেন। প্রথম চন্দ্রগুপ্তের পাটরানি কুমারদেবীর গর্ভে সমুদ্রগুপ্তের জন্ম হয়।
৩২০ খ্রিষ্টাব্দের বেশ কিছু পরে তিনি নিজেকে পিতার উত্তরসূরি ঘােষণা করে সিংহাসনে আরােহণ করেন। তিনি ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বী ছিলেন। উত্তরে হিমালয়, দক্ষিণে নর্মদা, পশ্চিমে যমুনা ও চম্বল নদী এবং পূর্বেব্ৰহ্মপুত্র নদ পর্যন্ত তার সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। সমুদ্রগুপ্ত শুধু একজন যােদ্ধা বা রাজ্যবিস্তারকারী সম্রাটই ছিলেন না, তিনি একাধারে বিদ্যোৎসাহী, সুকবি, সুদক্ষ শাসক ও সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম সম্পূর্ণ ভারতীয় মুদ্রার প্রচলন করেন। তার শিল্পমণ্ডিত স্বর্ণমুদ্রা গুপ্ত যুগের গৌরব। সমুদ্রগুপ্তের পরে সিংহাসনে আরােহণ করেন তার প্রথম পুত্র রামগুপ্ত।
রামগুপ্ত ছিলেন একজন অযােগ্য শাসক। তারপরে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বা বিক্রমাদিত্য ৩৮০ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে আরােহন করে ৪১৩ খ্রিষ্টাব্দে পরলােক গমন করেন। বিক্রমাদিত্য ছিলেন বীরযােদ্ধা ও সুদক্ষ শাসক। তিনি পাঞ্জাব, মথুরা অধিকার করে পরবর্তীতে মালব ও গুর্জরদের শকরাজ্যও অধিকার করেন। চৈনিক পরিব্রাজক ফা-হিয়েন তার শাসন ব্যবস্থার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। তার শাসনব্যবস্থা ছিল উদার জনকল্যাণমূলক। মৃত্যুর পর তার পুত্র কুমারগুপ্ত সিংহাসনে আরােহন করেন।
মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর দীর্ঘদিন বাংলায় ঐক্যবদ্ধ কোনাে রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল না। গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত পুষ্করণ রাজ্যের অধিপতি চন্দ্রবর্মাকে রাজিত করে পশ্চিম ও দক্ষিণ বাংলা অধিকার করেন। পরবর্তীতে বাংলার বেশিরভাগ অঞ্চল গুপ্তসাম্রাজ্যের অধীনে চলে আসে। খ্রিষ্টীয় ৪ থেকে ৭ শতক পর্যন্ত গুপ্ত সম্রাটরা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল শাসন করেন। বাংলার বিভিন্ন প্রত্নস্থল থেকে প্রচুর গুপ্ত স্বর্ণমুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। গুপ্ত সম্রাটগণ বাংলাকে শাসন করার সুবিধার্থে কতগুলাে ভাগে বিভক্ত। করেন। ভূক্তি, বিষয়, মূল, বীথি ও গ্রামে এসব প্রশাসনিক ভাগ ছিল। বাংলার ইতিহাসে প্রশাসনিক এবং ভূমি ব্যবস্থা চালুর ক্ষেত্রে গুপ্তদের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। গুপ্ত যুগে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা ভালাে ছিল। কিন্তু ৬ষ্ঠ শতকে গুপ্ত সাম্রাজ্য আন্তঃবিদ্রোহ ও ইনজাতির বার বার আক্রমণে দুর্বল হয়ে পড়লে বাংলায় গৌড ও বঙ্গ নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উত্থান ঘটে।
নালন্দা মহাবিহার প্রাচীন ভারতের মগধ রাজ্যে (বর্তমান বিহারে) অবস্থিত একটি খ্যাতনামা বৌদ্ধ শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। খ্রিষ্টীয় ৪২৭ অব্দে নালন্দা মহাবিহার প্রতিষ্ঠা করা হয়। ধারণা করা হয়, গুপ্ত সম্রাটগণই নালন্দা মহাবিহারের নির্মাতা এবং স্যাট প্রথম কুমারগুপ্তই এক্ষেত্রে প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সাত শতকের দিকে নালন্দা একটি শিক্ষাক্ষেত্র হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। সে সময়ে নালন্দায় ১০,০০০ শিক্ষার্থী এবং ২,০০০ শিক্ষক ছিলেন। তাদের অনেকেই কোরিয়া, জাপান, চীন, তিব্বত, ইন্দোনেশিয়া, ইরান এবং তুরস্ক থেকে আগত। চৈনিক তীর্থযাত্রী হিউয়েন সাঙ পড়াশােনা করার জন্য এখানে কয়েক বছর অতিবাহিত করেন।
Leave a Comment