নব্বইয়ের দশকে সাবেক সােভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রগুলাের মধ্যে অন্যতম ইউক্রেন। ইউক্রেনের অধিবাসীদের একটা বিরাট অংশ রুশ বংশােদ্ভূত। দু’দেশের জনগণ কখনােই ভাবেনি যে তাদের মধ্যে এমন বৈরিতা তৈরি হবে। শক্তিধর রাশিয়া ইউক্রেনের বিপক্ষে অবস্থান নেবে। ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নির্দেশে স্থল, আকাশ ও জলপথে ইউক্রেনে হামলা শুরু করে রুশ সেনাবাহিনী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটাই ইউরােপের কোনাে দেশে সবচেয়ে বড় হামলা।
ইউক্রেনের জন্ম
রুশ বিপ্লবের বহু আগে ইউক্রেনে জারের শাসন চলাকালীন ইউক্রেনীয়দের জাতীয়তাবাদ এবং স্বতন্ত্র পরিচয়ের রাজনীতি রাশিয়ায় নানা সমস্যা তৈরি করে। ১৯০৩ সালে রাশিয়ার সােশ্যাল ডেমােক্র্যাটরা মেনশেভিক ও বলশেভিক-এ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১৯০৫ সালে রাশিয়ায় প্রথম যে বিপ্লব ঘটে, তার ফলে রুশ জার দ্বিতীয় নিকোলাইয়ের পতন ঘটে। এরপর বলশেভিক এবং অক্টোবর বিপ্লবের সমন্বয়ে ১৯১৭ সালে আরেকটি বিপ্লব ঘটে, যার নামও রুশ বিপ্লব (Russian Revolution)।
এই বিপ্লবের মধ্যেই ১০ জুন ১৯১৭ ক্রিমিয়াসহ ইউক্রেনের এক বড় অংশ রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন ইউক্রেন প্রজাতন্ত্রের ঘােষণা দেয়। ২৫ অক্টোবর ১৯১৭ (পুরােনাে বর্ষপঞ্জির হিসেবে) আর নতুন গ্রেগােরিয়ান নিয়মে ৭ নভেম্বর ম্লাদিমির ইলিচ। লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ায় জার শাসনের অবসান হয়। তার নেতৃত্বাধীন সােভিয়েত সরকার স্বাধীন। ইউক্রেন গঠনের চেষ্টাকে দমন করে। ইউক্রেনের বেশির ভাগ ভূখণ্ডই সােভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
অন্যদিকে পশ্চিম ইউক্রেনের কিছু অংশ পােল্যান্ড, চেকোশ্লোভাকিয়া আর রােমানিয়ার মধ্যে ভাগাভাগি করা হয়। ৩০ ডিসেম্বর ১৯২২ ইউক্রেন সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। অবশেষে সাত দশকেরও বেশি সময় পর সােভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার মধ্যে দিয়ে ১৯৯১ সালে জন্ম হয়। স্বাধীন ইউক্রেন রাষ্ট্রের। ২৪ আগস্ট ইউক্রেন আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘােষণা করে। ১ ডিসেম্বর ১৯৯১ অনুষ্ঠিত এক গণভােটে জনগণ স্বাধীনতার পক্ষে রায় দেয়।
সংকটের উৎস
ইউক্রেনে দুটি রাজনৈতিক ধারা প্রবল। একটি পশ্চিম ইউরােপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে চায়। তারা ইউরােপীয় ইউনিয়নে (EU) যােগ দেওয়ার পাশাপাশি পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য হতে আগ্রহী। অন্যদিকে, অপর ধারাটি রুশপন্থী। তারা রাশিয়ার বলয়ে থাকতে চায়। ইউক্রেনের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ রুশভাষী। ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার দ্বন্দ্বের প্রধান কারণ North Atlantic Treaty Organization (NATO), যা গঠন করা হয় ৪ এপ্রিল ১৯৪৯। সাবেক সােভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার বিরুদ্ধের একটি সামরিক জোট ই ন্যাটো।
অন্যদিকে স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন ইউরােপের আটটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নিয়ে ১৪ মে ১৯৫৫ গঠিত হয় আরেকটি সামরিক জোট ওয়ারশ প্যাক্ট (Warsaw Pact)। ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে সােভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর সােভিয়েত বলয়ভুক্ত সামরিক জোট ওয়ারশ ১ জুলাই ১৯৯১ ভেঙে যায়। পােল্যান্ডের ওয়ারশ-এ বসে সামরিক জোট ওয়ারশ প্যাক্ট করা হয়। সেই পােল্যান্ডই এখন ন্যাটোর সদস্য। রাশিয়া ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত হতে চাইলে অন্য সদস্যরা ভেটো দেয়। অথচ ওয়ারশতে ছিল এমন অনেক দেশকে ন্যাটোর সদস্য করা হয়। ১২ মার্চ ১৯৯৯ চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি ও পােল্যান্ড ন্যাটোতে যােগ দেয়।
২৯ মার্চ ২০০৪ তাদের পথ অনুসরণ করে বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, রােমানিয়া ও স্লোভাকিয়া। ১ এপ্রিল ২০০৯ যােগ দেয় আলবেনিয়া। এ দেশগুলাে একসময় সােভিয়েত। ইউনিয়নের অংশ ছিল এবং ওয়ারশ সামরিক জোটের সদস্যও। জর্জিয়া, মলদোভা এবং ইউক্রেনও ন্যাটো বা ইউরােপীয় ইউনিয়নে। (EU) যােগ দিতে চায়। কিন্তু রাশিয়া এ ব্যাপারে কঠোর থাকায় দেশগুলাের যােগ দেওয়া হয়নি। এ দেশগুলাের যেকোনাে একটি দেশ বিশেষ করে ইউক্রেন যদি কোনােভাবেই ন্যাটো বা ইউরােপীয় ইউনিয়নে যােগ দেয় তাহলে রাশিয়ার সাথে যুদ্ধের স্ফুলিঙ্গ হিসেবে। কাজ করতে পারে। রাশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। মনে করেন, পশ্চিমা শক্তি আসলে ন্যাটো জোটকে ব্যবহার করে চারদিক থেকে রাশিয়াকে ঘিরে ফেলছে।
সাম্প্রতিক সংকট
২০১৩ সালে রাশিয়ার কারণে ইউক্রেন ইউরােপীয় ইউনিয়নে (EU) যােগ দেওয়ার চেষ্টা থেকে সরে আসে। ইউক্রেনের জনগণ। এটা মেনে নেয়নি। ২০১৪ সালে তীব্র আন্দোলনের মুখে রুশপন্থী। প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ পদত্যাগ করে রাশিয়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। সাম্প্রতিক ইতিহাস বিবেচনায় নিলে তখন থেকেই চলমান সংকটের সূত্রপাত।
ইয়ানুকোভিচের পর যারা ইউক্রেনের ক্ষমতায় আসেন, তারা EU বা পশ্চিমা পন্থী বলে । পরিচিত। তাদের নানা পদক্ষেপে পুতিন ক্ষুব্ধ হন। তিনি বিশ্বে তার সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি অটুট রাখতেই ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করে নেন। এরপর রাশিয়া ইউক্রেনের দোনেৎস্ক । ও লুহানস্ককের রুশ সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহযােগিতা দিয়ে । আসছিল। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ পুতিন অঞ্চল দুটির স্বাধীনতার স্বীকৃতি সংক্রান্ত ডিক্রিতে স্বাক্ষর করেন। এরপর ২৪ ফেব্রুয়ারি। ২০২২ ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের নির্দেশ দেন।
সামরিক হামলা বন্ধে বৈঠক ও শর্ত
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ও ৩ মার্চ বেলারুশ সীমান্তের গােমেল অঞ্চলে ইউক্রেন এবং রাশিয়ার মধ্যে দুই দফার শান্তি । আলােচনা হয়। ১০ মার্চ ২০২২ যুদ্ধবিরতি নিয়ে তুরস্কের আলিয়া শহরে রাশিয়া ও ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা বৈঠকে মিলিত হলে তাও কার্যত ব্যর্থ হয়। এরপর ১৪ মার্চ ২০২২ দুই দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে ভার্চুয়ালি আলােচনা হলেও কোনাে সমাধান আসেনি।
আগ্রাসন বন্ধে রাশিয়ার শর্ত তিনটি-ইউক্রেনকে অবশ্যই মেনে নিতে হবে যে দখলকৃত ক্রিমিয়া রাশিয়ার অংশ। দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্র। হিসেবে মেনে নিতে হবে। ইউক্রেনের সংবিধান সংশােধন করতে হবে এবং ন্যাটো জোট বা এমন কোনাে জোটে অন্তর্ভুক্তির অভিলাষ পরিত্যাগ করতে হবে।
রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল
কৃষ্ণসাগরের উত্তর উপকূলে অবস্থিত ছােট উপদ্বীপ ক্রিমিয়া। শতকের পর শতক ধরে সাম্রাজ্যবাদীদের ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের শিকারে পরিণত হয় ভূখণ্ডটি। ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হলে ক্রিমিয়ায়ও সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। ১৩ ডিসেম্বর ১৯১৭ farface Crimean People’s Republic c on করা হয় । ১৮ অক্টোবর ১৯২১ ক্রিমিয়া সােভিয়েত প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। ৩০ জুন ১৯৪৫ রুশ সােভিয়েত ফেডারেটিভ সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের (RSESR) আওতায় ক্রিমিয়াকে প্রদেশ হিসেবে ঘােষণা করা হয়।
১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৪ সােভিয়েত কম্যুনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নিকিতা ক্রুশ্চেভ (যিনি ছিলেন একজন ইউক্রেনীয়) একটি ডিক্রি জারি করে ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের কাছে হস্তান্তর করেন। কৌশলগত কারণে রাশিয়ার কাছে ক্রিমিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই সুযােগ পেয়ে ২০১৪ সালে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া দখল করে নেয় রাশিয়া। ২১ মার্চ ২০১৪ ক্রিমিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়।
সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু ডনবাস
দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক—এ দুটিই পূর্ব ইউক্রেনের ডনবাস অঞ্চলে অবস্থিত। এক সময় এলাকা দু’টি ছিল খনিজ সম্পদ এবং ইস্পাত উৎপাদন ভারী শিল্পের কেন্দ্র। দুটি অঞ্চলের মােট জনসংখ্যা ৩৮ লাখের মতাে এবং এদের একটি বড় অংশই রুশ অথবা রুশ-ভাষী। উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে দোনেৎস্ক ছিল কয়লাখনির মূল কেন্দ্র। ১৮৬৯ সালে জন হিউস নামে ওয়েলসের একজন ব্যবসায়ীর নামে ঐ এলাকার নামকরণ করা হয় Hughesovka বা Yuzovka। তিনি ঐ এলাকায় ইস্পাতের কারখানা এবং বেশ কয়েকটি কয়লা খনি গড়ে তােলেন। ১৯১৭ সালে এটি নগরীর মর্যাদা লাভ করে।
১৯২৪ সালে শহরটির নতুন নাম হয় স্তালিন। এরপর ১৯২৯ সালে নাম বদলে স্তালিনাে এবং সর্বশেষ ১৯৬১ সালে হয় দোনেৎস্ক। সােভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটার পর, এই দুটি এলাকা ইউক্রেনের অংশ হয়। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখলের পর পুতিন নজর দেন ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের রুশভাষী দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলের ওপর। এ সুযােগে রুশ-সমর্থক বিদ্রোহীরা ১২ মে ২০১৪ এলাকা দুটি আলাদা ‘পিপলস রিপাবলিক হিসেবে ঘােষণা করে। এরপর থেকে ইউক্রেনীয় বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের ক্রমাগত লড়াই চলছে।
ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যস্থতায় ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ বেলারুশে ‘মিনস্ক চুক্তি হয়। তাতে রাশিয়া ও ইউক্রেন একমত হয় যে দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চল দু’টিকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া ই হবে আর এর বিনিময়ে ইউক্রেন তার সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাবে। কিন্তু এ চুক্তির বাস্তবায়ন বার বার ঠেকে গেছে। সর্বশেষ ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন একটি ডিক্রিতে স্বাক্ষর করে দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চল দু’টিকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেন।
জানেন কি
এক সময় পরমাণু শক্তিধর দেশ ছিল ইউক্রেন। কিন্তু বৈশ্বিক রাজনীতির প্যাচে পড়ে সেই পরমাণু অস্ত্র ত্যাগ করে দেশটি। ১৯৯১ সালে সােভিয়েত ইউনিয়ন। ভেঙে গেলে রাশিয়ার পরমাণু অস্ত্র ভাণ্ডারের এক-তৃতীয়াংশই ইউক্রেনে থেকে যায়। ১৯৯৪ সালেও বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পরমাণু শক্তিধর দেশ ছিল ইউক্রেন। কিন্তু ৫ ডিসেম্বর ১৯৯৪ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে একটি চুক্তি। স্বাক্ষরিত হয়। এদের কাছ থেকে নিরাপত্তা সুরক্ষা গ্যারান্টির প্রতিশ্রুতিতে সেই পরমাণু অস্ত্র ত্যাগ করে ইউক্রেন। ইউক্রেনই। একমাত্র রাষ্ট্র, যারা পরমাণু শক্তিধর দেশ হয়েও পরমাণু কর্মসূচি। ত্যাগ করে। চুক্তি মােতাবেক ইউক্রেন তার হাতে থাকা। পারমাণবিক বােমাগুলাে রাশিয়ার হাতে তুলে দেয়। স্বার্থান্বেষী হয়ে রাশিয়া সে চুক্তিও উপেক্ষা করে।
- ‘ইউরােপের রুটির ঝুড়ি’ বলা হয় ইউক্রেনকে।
- আয়তনে ইউরােপের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ ইউক্রেন।
- ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ।
- ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটে ইউক্রেনের প্রিপসাত এলাকার চেরনােবিল নিউক্লিয়ার প্লান্টে ২৬ এপ্রিল ১৯৮৬।
- ইউক্রেনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভলােদিমির জেলেনস্কি।