মােগল ও ইউরােপীয় শৈলীর মিশ্রণে তৈরি ঔপনিবেশিক আমলের বিখ্যাত স্থাপনা ঢাকার বর্ধমান হাউস। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বহু মােড় পরিবর্তন করা ঘটনার সঙ্গে রয়েছে বর্ধমান হাউসের গভীর সম্পর্ক। ইতিহাসবিদ শরীফ উদ্দিন আহমেদ সম্পাদিত ‘ঢাকা কোষ’-এ বলা হয়েছে, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর এই ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল। অবিভক্ত বাংলার বর্ধমানের মহারাজা স্যার বিজয় চাদ মাহতাব ১৯১৯ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত এই বাড়িতে থাকতেন বলে এর নাম হয় বর্ধমান হাউস।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বাসভবন হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে এই ভবন। তবে বিভিন্ন সময়ে সংস্কারের কারণে বর্ধমান হাউস তার আগের রূপ কিছুটা হারিয়েছে। দাপ্তরিক কাজ না হলেও বাংলা একাডেমির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভবনটি। সেখানে স্থাপন করা হয়েছে দুটি জাদুঘর- ‘ভাষা আন্দোলন জাদুঘর’ ও ‘লেখক জাদুঘর’।
২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন জাদুঘর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই জাদুঘরে ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক আলােকচিত্র, সংবাদপত্র, স্মারকপত্র, ব্যঙ্গচিত্র, চিঠি, প্রচারপত্র, পাণ্ডুলিপি, পুস্তক-পুস্তিকার প্রচ্ছদ এবং ভাষাশহীদদের স্মারকচিহ্ন সংরক্ষণ করা হয়েছে। বর্ধমান হাউসের নিচতলায় রয়েছে জাতীয় সাহিত্য ও লেখক জাদুঘর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি জাদুঘরটি উদ্বোধন করেন।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রতিটি অধ্যায়ের অন্যতম স্মারক বর্ধমান হাউস। ১৯৪৭ সালের ৫ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিক্ষকেরা মিছিল সহকারে এ ভবনে এসে মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকের সময় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি পেশ করেন। ১৯৪৮ সালের ৮ জানুয়ারি সন্ধ্যায় বর্ধমান হাউসে প্রধানমন্ত্রী নাজিমউদ্দিনের সঙ্গে ভাষা আন্দোলনের নেতারা সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাতের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি এবং ভাষা আন্দোলনের কর্মীদের গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের প্রতিবাদ কর।
১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা চুক্তির আগে এখানে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের সঙ্গে তকালীন গভর্নর খাজা নাজিমউদ্দিনের বৈঠক হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল নুরুল আমিন এই ভবনে বাস করতেন।
রক্তাক্ত একুশে ফেব্রুয়ারির পরপরই বর্ধমান হাউসকে বাংলা ভাষা চর্চার কেন্দ্র করার দাবি ওঠে। এটি আনুষ্ঠানিক রূপ পায় ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের সময়। যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার দাবিতে। দাবি মানা হয় ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর। বর্ধমান হাউসে বাংলা একাডেমি উদ্বোধন করেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী আবু হােসেন সরকার। গবেষণা-প্রকাশনার মননশীল চর্চার পাশাপাশি বাংলা একাডেমি একুশের চেতনাকে ধারণ করছে।
Leave a Comment