এ. কে. ফজলুল হকের প্রথম মন্ত্রিসভা (১৯৩৭-১৯৪১)
কংগ্রেস মুসলিম লীগ অথবা কৃষক-প্রজা পার্টির সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠনে অসম্মতি জানায়। শেষ পর্যন্ত এ. কে, ফজলুল হকের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ ও কৃষক-প্রজা পার্টির কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। এইচ. এস. সােহরাওয়ার্দী, নবাব হাবিবুল্লাহ, খাজা নাজিমউদ্দীন, মােশারফ হােসেন, স্যার নলিনীরঞ্জন সরকার প্রমুখ সদস্য নিয়ে হক মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। হক সাহেব হলেন মুখ্যমন্ত্রী। তার মন্ত্রিত্বকালে বেশ কয়েকটি জনকল্যাণমূলক কাজ সম্পন্ন হয়। ফজলুল হকের মন্ত্রিসভা বাংলার ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা করে। তাঁর নেতৃত্বে স্বায়ত্তশাসন বহুলাংশে কার্যকর হয়।
কৃষকদের অবস্থার উন্নতির জন্য হক মন্ত্রিসভা ১৯৩৮ সালে বঙ্গীয় কৃষি-খাতক আইন প্রণয়ন করে। এ মন্ত্রিসভা প্রায় ৬০ হাজার ঋণ সালিশী বাের্ড স্থাপন করে। এ বাের্ডগুলাের কাজ ছিল ঋণ-খাতকদের সুবিধাজনক কিস্তিতে ঋণ পরিশােধের ব্যবস্থা করে দেওয়া। কৃষি-খাতক আইন দ্বারা প্রজাদের ওপর জমিদারের অত্যাচার শােষণ বন্ধ করা হয়। এ আইনের ফলে ভূমিকর বৃদ্ধি করা এবং প্রজার জমি দখল করা বন্ধ হয়ে যায়।
হক মন্ত্রিসভা বঙ্গীয় কুসিদজীবী (Bengal Money Lenders Act) আইন তৈরি করে। এ আইন সুদের ব্যবসা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে কৃষকসমাজ বেশ উপকৃত হয়। হক মন্ত্রিসভা শিক্ষা বিস্তারের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। হক মন্ত্রিসভা মাদরাসা শিক্ষা পুনর্গঠন করে। ফজলুল হক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা আইন প্রণয়ন করেন এবং প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য প্রত্যেক জেলায় স্কুল বাের্ড স্থাপন করেন। ঢাকার কৃষি কলেজ ও বরিশালের চাখার কলেজ স্থাপন হক সাহেবের কৃতিত্ব। মুসলমানদের নারীশিক্ষা প্রসারের জন্য ঢাকায় ইডেন গার্লস কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
মাধ্যমিক শিক্ষার সুব্যবস্থার জন্য ১৯৪০ সালে তিনি মাধ্যমিক শিক্ষা বিল প্রণয়ন করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃত্ব হতে মাধ্যমিক শিক্ষার ভার মাধ্যমিক শিক্ষা বাের্ডের ওপর হস্তান্তরিত হলে হিন্দুদের প্রাধান্য নষ্ট হয়ে যাবে, এ অজুহাতে কয়েকজন হিন্দুনেতা শিক্ষা বিলের বিরােধিতা করেন। হক সাহেব সরকারি চাকরির শতকরা ৫০ ভাগ মুসলমানদের জন্য সংরক্ষণ করেন।
অন্যান্য সম্প্রদায়ের সরকারি চাকরিতে নিয়ােগের বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এ ব্যবস্থা তদারক করার জন্য একজন সাম্প্রদায়িক অনুপাত কর্মকর্তা (Communal Ratio Officer) নিয়ােগ করা হয়। হিন্দুদের প্রাধান্য হ্রাস করার জন্য ফজলুল হক কলকাতা মিউনিসিপ্যালিটি আইন সংশােধন করেন। হক মন্ত্রিসভার কৃতিত্বের ফলে বাংলার মুসলমানদের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থার উন্নতি হয়। প্রজাগণ জমিদার ও মহাজনদের অত্যাচার থেকে মুক্তি পায়। জমির ওপর তাদের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষিতের হার বৃদ্ধি পায়।
এ. কে. ফজলুল হকের দ্বিতীয় মন্ত্রিসভা (১৯৪১ -১৯৪৩)
১৯৪১ সালে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে মতানৈক্যের ফলে এ. কে. ফজলুল হক মুসলিম লীগ ত্যাগ করেন। এ বছরেই নভেম্বরে তিনি প্রগ্রেসিভ কোয়ালিশন পার্টি গঠন করেন। ডিসেম্বর মাসে তিনি হিন্দু-মুসলিম নেতা ড: শ্যামাপ্রসাদের সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠন করেন। এ মন্ত্রিসভা শ্যামা-হক মন্ত্রিসভা নামে পরিচিত। শ্যামা-হক মন্ত্রিসভাকে মুসলিম লীগ সুনজরে দেখেনি। এ মন্ত্রিসভা দমনমূলক কতকগুলাে বিধি জারি করলে জনপ্রিয়তা হারায়।
প্রকৃতপক্ষে হিন্দুনেতাদের সংকীর্ণতা ও অদূরদর্শিতা শ্যামা-হক মন্ত্রিসভার পতনকে ত্বরান্বিত করে। এরপর প্রথমে খাজা নাজিমউদ্দীন এবং পরে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা গঠিত হয়।। ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট ভারত বিভক্ত হওয়া পর্যন্ত মুসলিম লীগ ক্ষমতাসীন ছিল।