‘চিলেকোঠার সেপাই’ উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস রচিত একটি মহাকাব্যিক উপন্যাস। তকালীন গণআন্দোলনের সাথে কৃষক, শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষের একাত্মতা প্রকাশ পায় উপন্যাসটিতে। এ উপন্যাসে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন গণঅভ্যুত্থান চলাকালীন পূর্ব বাংলার চিত্র।
ঔপন্যাসিক ছোট ছােট কাহিনিপরে সুন্দর। সম্মিলনের মাধ্যমে উপন্যাসটিকে একটি মহাকাব্যিক রূপ দিয়েছেন। শহরের বস্তি থেকে শুরু করে যমুনার দুর্গম চর এলাকা পর্যন্ত উপন্যাসটির। কাহিনি বিস্তৃত হয়েছে। অতি সূক্ষ্ম এবং নিবিড় পর্যবেক্ষণ শক্তিতে উপন্যাসের শব্দে শব্দে একটি আলাদা দ্যোতনা সৃষ্টি হয়েছে।
এই বিভাগ থেকে আরো পড়ুন
- ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ : সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্
- বন্দী শিবির থেকে : শামসুর রাহমান
- পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় : সৈয়দ শামসুল হক
- লালসালু উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু
- ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস
লেখকের “অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন লেখায় একেকটি চরিত্রের বাস্তবতা, পরাবাস্তবতা, ঘটনার সাথে চরিত্রের বাস্তবতা, কল্পনার মিশ্রণে প্রতিটি পৃষ্ঠায় পাঠক নতুন দৃষ্টিতে জীবনকে আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। উপন্যাসের কাহিনিবিন্যাসই পাঠককে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়। উপন্যাসটি ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে রােববার নামের সাপ্তাহিক পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় এবং ১৯৮৭ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
গ্রন্থ সংক্ষেপ
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে ১৯৬৯ সালে ব্যাপক গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টি হয়েছিল। সে গণঅভ্যুত্থান সব অর্থেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অনন্য। উনসত্তরের প্রবল গণঅভ্যুত্থানের যারা প্রধান শক্তি ছিল, সেই শ্রমজীবী জনসাধারণ মানুষ কীভাবে আন্দোলন-পরবর্তী সময়টিতে প্রতারিত এবং বঞ্চিত হলাে, বামপন্থীদের দোদুল্যমানতা আর ভাঙনের ফলে, জাতীয় মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে যথাযথভাবে ধারণ করতে না পারার কারণে অজস্র রক্তপাতের পরও রাজনীতির ময়দান থেকে তাদের পশ্চাদপসরণ ঘটলাে, আওয়ামী লীগ প্রধান শক্তি হয়ে উঠলাে, উপন্যাসটির উপজীব্য সেই ঐতিহাসিক সময়টুকুই।
মসুল হােসেনের ছেলে, আবু তালেবের মিছিলে গিয়ে গুলিতে মারা যাওয়ার সংবাদের মধ্য দিয়ে উপন্যাসটির কাহিনি এগিয়ে চলে। ওসমান এ উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান চরিত্র, যে একজন ছােটখাটো সরকারি চাকুরে। এ উপন্যাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হাড়ি খিজির।
যে ওসমানের বাড়িওয়ালা রহমতউল্লাহর ভাগ্নে আলাউদ্দিন মিয়ার গ্যারেজ দেখাশােনা করে। এই দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রা ও স্তরের চরিত্রই উপন্যাসটিকে টেনে নিয়ে গেছে উনসত্তরের উত্তাল সময়ের ভেতর দিয়ে। আরেকটি গুরুত্ববহ চরিত্র আনােয়ার, যে মূলত একজন বামপন্থী কর্মী।
উনসত্তরের টালমাটাল বিক্ষুব্ধ সময়েই সে ঘটনাক্রমে তার গ্রামের বাড়িতে যায় এবং প্রত্যক্ষ করে জনৈক গ্রাম্য জোতদার খয়বার গাজীর শােষণ ও অত্যাচার এবং সেটিকে কেন্দ্র। করে সৃষ্ট তীব্র জনরােষ। উপন্যাসের কাহিনিকে পূর্ণতা দিতেই উঠে আসে দরিদ্র যুবক চেন্টু কিংবা কমালি, যারা খয়বার গাজীর বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবার ধৃষ্টতা দেখায়।
অন্যদিকে স্বাভাবিক নিয়মেই গতি পায় ওসমানের অবদমিত কামনা, রেস্তোরার আড্ডায় চায়ের কাপে তুমুল ঝড়, হাড্ডি খিজির ও তার পারিপার্শ্বিক নিম্নবিত্ত চরিত্রগুলাের চিরাচরিত জীবনযাপন; আর এ সবকিছুই ছাপিয়ে উপন্যাসটি হয়ে ওঠে ঐ বিক্ষুব্ধ কালের এক মহাকাব্যিক আখ্যান। উপন্যাসের শেষ পর্যায়ে।
চিলেকোঠার চার দেয়াল থেকে মুক্তির প্রচেষ্টা ওসমানকে উন্মত্ত করে তােলে। পরিচিতরা বদ্ধ পাগল হিসেবে চিহ্নিত করে তাকে আটকে রাখে। শেষ পর্যন্ত নিহত খিজিরের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে সে ঘরের তালা ভেঙে সবার অগােচরে রাস্তায় বেড়িয়ে আসে। মূলত, চিলেকোঠার চার দেয়ালের বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার সাথে সাথে বিচ্ছিন্নতা ও আত্মপ্রেমের বন্ধন থেকেও তার মুক্তি ঘটে। বৃহত্তর গণআন্দোলনের জোয়ারে অবশেষে ওসমান একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে মিশে যেতে সক্ষম হয়।
লেখক পরিচিতি
- জন্ম : ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩, গােটিয়া গ্রাম, গাইবান্ধা (মাতুলালয়); তার পৈতৃক নিবাস বগুড়া।
- গল্পগ্রন্থ : অন্য ঘরে অন্য স্বর (১৯৭৬), খোয়ারি (১৯৮২), দুধেভাতে উৎপাত (১৯৮৫), দোজখের ওম (১৯৮৯), জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল (১৯৯৭)।
- প্রবন্ধগ্রন্থ : সংস্কৃতির ভাঙা সেতু (১৯৯৮)।
- উপন্যাস : চিলেকোঠার সেপাই (১৯৮৭) ও খােয়াবনামা (১৯৯৬) ।
- পুরস্কার : হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৭), বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮২), আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৭), সা’দ ওলী আখন্দ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৬), আনন্দ পুরস্কার (১৯৯৬).ও একুশে পদক (মরণােত্তর) (১৯৯৮)।
- মৃত্যু : ৪ জানুয়ারি, ১৯৯৭, ঢাকা (ক্যান্সার রােগে)।
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন
প্রশ্ন : ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসটির রচয়িতা কে?
উত্তর : আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। [বিটিভি’র সহকারী প্রকৌশলী (সিভিল) ২০১৭)।
প্রশ্ন : উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাস কোনটি?
উত্তর : চিলেকোঠার সেপাই। [ট্যারিফ কমিশনের গবেষণা কর্মকর্তা ২০১৮]