জনসংখ্যা সমস্যা : বর্তমান বাংলাদেশের অন্যতম মারাত্মক ও ভয়াবহ সমস্যা হল জনসংখ্যা সমস্যা। বাংলাদেশ সরকার এ সমস্যাকে এক নম্বর জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যা হল ১১ কোটি ১৪ লক্ষ এবং প্রতিবর্গ কিলােমিটারে প্রায় ৭৫৫ জন লােক বাস করে। এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২.১৭% ভাগ।
২০০০ সালের বিশ্ব জনসংখ্যা ডাটাশিট অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি বর্গ কিলােমিটারে প্রায় ৮৬৮ জন লােক বাস করে। ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১২.৯২ কোটি এবং প্রতি বর্গ কিলােমিটারে প্রায় ৮৭৬ জন লােক বাস করে।
আরো পড়ুন : সামাজিক বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য এবং সামাজিক মূল্যবােধের অবক্ষয়ের কারণ
জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৪৮% এবং প্রতি দিন বাংলাদেশে প্রায় ৬ হাজার ৫শত শিশু জন্মগ্রহণ করে। দেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৪ কোটি ৬ লক্ষ। প্রতিবর্গ কিলােমিটারে ৯৫৩ জন মানুষ বাস করে এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৪১। বাংলাদেশের পক্ষে যেখানে শুধুমাত্র তার জনসংখ্যার ন্যূনতম চাহিদা মেটানাের ব্যবস্থা করাই দুঃসাধ্য সেখানে বর্ধিত জনসংখ্যার চাহিদা পূরণ এক অস্বাভাবিক ব্যাপার। ফলে বেড়ে যাচ্ছে দারিদ্র্য, বেকারত্ব, নির্ভরশীলতা, বাসস্থান সংকট, খাদ্য সমস্যাসহ আরাে বহু রকম সামাজিক সমস্যা।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণ :
বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রধান কারণগুলাে হচ্ছে
১। শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রসরতা : বাংলাদেশের প্রায় অধিকাংশ লােকই নিরক্ষর ও শিক্ষার সুযােগ থেকে বঞ্চিত। নিরক্ষর ও অশিক্ষিত মানুষ অধিক সন্তানের ফলে সৃষ্ট সমস্যা সম্পর্কে অজ্ঞ।
২। মহিলাদের কর্মসংস্থানের অভাব : যে দেশে নারীশিক্ষার হার যত বেশি সে দেশে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার তত কম। শিক্ষিত কর্মজীবী মহিলারা সংসারের বাইরে কর্মে ব্যস্ত থাকে এবং জীবন সম্পর্কে অধিক সচেতন বলে তারা কম সন্তান কামনা করে।
৩। দারিদ্র্য : দেশের জনসংখ্যার বৃহৎ অংশই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। দারিদ্র বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম একটি কারণ। তাই বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি।
৪। ধর্মীয় গোঁড়ামি : বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির একটি প্রধান কারণ হল ধর্মীয় গোঁড়ামি। ধর্মভীরু মানুষ বিয়ে ও সন্তান জন্মদানকে পবিত্র জ্ঞান করে। সন্তান জন্মদানে মানুষের হাত নেই। “মুখ দিয়েছেন যিনি, আহার দেবেন তিনি”- এ জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি জনসংখ্যার বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
আরো পড়ুন : সামাজিক পরিবর্তন, সামাজিক পরিবর্তনের সংজ্ঞা , বৈশিষ্ট্য ও বিভিন্ন উপাদান
৫। বাল্যবিবাহ : গ্রামীণ বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের প্রচলন অত্যন্ত বেশি। জনসংখ্যার বৃদ্ধিতে বাল্যবিবাহ মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করে।
৬। সামাজিক নিরাপত্তার অভাব : বাংলাদেশে এখনাে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি গৃহীত হয় নি। বৃদ্ধ ও অবসর কালীন সময়ের নিরাপত্তার একমাত্র সম্বল হল সন্তান-সন্ততি। ফলে এদেশের মানুষ অধিক সন্তান কামনা করে।
৭। চিত্তবিনােদনের অভাব : আমাদের দেশে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে চিত্তবিনােদনের খুবই অভাব রয়েছে। ফলে স্বামী স্ত্রীর একে অপরের সঙ্গ কামনাই চিত্তবিনােদনের একমাত্র উৎস বলে বিবেচিত হয়। তাই দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি পরিলক্ষিত হয়।
প্রতিকার :
বাংলাদেশে জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে নিম্নলিখিত ব্যবস্থাগুলাে গ্রহণ করা যেতে পারে।
(ক) জনসংখ্যা নীতি প্রণয়ন: জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও পরিবার পরিকল্পনা সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বাস্তব জনসংখ্যা নীতি প্রণয়ন অত্যাবশ্যক। বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকারের জাতীয় জনসংখ্যা নীতি রয়েছে।
(খ) পরিবার পরিকল্পনা : পরিবার পরিকল্পনার মাধ্যমে এ দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভ। শুধু তাই নয়, পরিকল্পিত পরিবারের মাধ্যমে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শূন্যের কোঠায় আনা সম্ভব।
(গ) শিক্ষার সম্প্রসারণ : শিক্ষা হল জনসংখ্যা রােধের অন্যতম উপায়। বিশেষ করে এ দেশের নারীশিক্ষা বৃদ্ধির মাধ্যমে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা সমভব।
(ঘ) কর্মসংস্থান সৃষ্টি : মহিলাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ প্রবণতা বাড়লে প্রজনন হার কমে। সুতরাং তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা উচিত।
আরো পড়ুন : সামাজিক স্তরবিন্যাস, সামাজিক স্তরবিন্যাসের সংজ্ঞা ও সামাজিক স্তরবিন্যাসের বৈশিষ্ট্য ও প্রকারভেদ
(ঙ) বিনােদনমূলক ব্যবস্থার সম্প্রসারণ : দেশে সুস্থ ও কল্যাণধর্মী বিনােদনমূলক ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ঘটলে জনসংখ্যা হ্রাস পাবে। এজন্য গ্রামীণ পর্যায়ে টিভি, সিনেমা প্রভৃতি চিত্তবিনােদনের মাধ্যমগুলাের সম্প্রসারণের ব্যবস্থা করা উচিত।
(চ) বাল্যবিবাহ : আইনের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ রােধ করতে হবে এবং বিবাহের সর্বনিম্ন বয়স মেয়েদের বেলায় ২০ এবং ছেলেদের বেলায় ২৫ বছর করতে হবে। এ শর্ত ভঙ্গ করলে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
(ছ) অপরাধ : অপরাধ হল এক ধরনের অস্বাভাবিক আচরণ যা সমাজ ও প্রচলিত আইন কর্তৃক স্বীকৃত নয়। সমাজবিজ্ঞানী কোনিগ (Koenig) বলেন, “সমাজ বা গােষ্ঠী দ্বারা দৃঢ়ভাবে অসমর্থিত বা নিষিদ্ধ মানব আচরণই হল অপরাধ।” যেমন- চুরি করা, ভেজাল দেওয়া, খুন করা, ঘুষ খাওয়া ইত্যাদি হল অপরাধমূলক কাজ।
বাংলাদেশে অপরাধের কারণ : বাংলাদেশে অপরাধ বৃদ্ধির কারণ অনেক। এসব কারণ উদঘাটন করতে হলে ব্যক্তির দৈহিক, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক অবস্থা- এগুলাে বিশ্লেষণ করার প্রয়ােজন রয়েছে। নিম্নে বাংলাদেশে অপরাধ বৃদ্ধির কারণগুলাে বর্ণনা করা হল।
১। ভৌগােলিক কারণ : অপরাধ-বিজ্ঞানী আবুল হাসনাত বলেন, বাংলাদেশে জুন ও ডিসেম্বর মাসে ডাকাতি বৃদ্ধি পায়। অপরাধ-বিজ্ঞানী লমব্রাসাের (Lombroso) মতে, “খুন-জখম সমতল ভূমিতে কম, পাহাড়ি অঞ্চলে বেশি। বাংলাদেশে চর-অঞ্চলে অপরাধ কম-বেশি সংঘটিত হয়।
২। দারিদ্র্য : বাংলাদেশে চরম দারিদ্র্যের কারণে অপরাধকর্ম সংঘটিত হয়। ছােট ছােট চুরি, ডাকাতি, পকেটমার, সিঁধেল চুরি, প্রভৃতি অপরাধগুলাে সাধারণ দারিদ্র্যের কারণেই হয়ে থাকে।
৩। বেকারত্ব : আমাদের দেশে ক্রমবর্ধমান হারে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেকে হতাশাগ্রস্ত হয়ে অপরাধকর্মে জড়িয়ে পড়ে। এরা তাই অনেকে ছিনতাই, খুন, মদ্যপান, হেরােইন সেবন ইত্যাদি অপরাধমূলক কর্মে লিপ্ত হয়।
৪। পারিবারিক কারণ : পারিবারিক বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। যে পরিবারে শিশুদের গড়ে | ওঠার জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ নেই সে পরিবারের শিশু-কিশােররা অপরাধী হতে বাধ্য।
৫। সামাজিক মূল্যবােধের অভাব : সামাজিক মূল্যবােধের অভাব বাংলাদেশে অপরাধ বৃদ্ধির কারণ। আমরা সৎ, শিক্ষিত, ন্যায়বান লােক অপেক্ষা ধনী লােককে বেশি সম্মান প্রদর্শন করি। অর্থই সামাজিক মর্যাদার মাপকাঠি’ তাই মানুষ যেনতেনভাবে অর্থ উপার্জন করতে গিয়ে নানা ধরনের অপরাধ কর্মে লিপ্ত হয়।
৬। রাজনৈতিক কারণ : রাজনৈতিক অস্থিতিশলীতা, অস্থিরতা, রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের অনিয়মতান্ত্রিক প্রতিযােগিতা, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, রাজনৈতিক স্বার্থে ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান হারে অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৭। জেলখানী ও বিচারালয়ের প্রভাব : বিচার ব্যবস্থায় ত্রুটি, দীর্ঘসূত্রিতা এবং জটিল প্রক্রিয়ার দরুন অনেক সময় নিরপরাধ ব্যক্তি শাস্তি পায়। এছাড়া জেলখানায় দাগি ও পেশাদার অপরাধীদের সংস্পর্শে কিশাের অপরাধী ও ছােট ছােট অপরাধী দাগি অপরাধীতে পরিণত হয়।
প্রতিকার :
“অপরাধকে ঘৃণা কর, অপরাধীকে নয়”- এ দৃষ্টিভঙ্গি হতে অপরাধ ও অপরাধীকে বিচার-বিশ্লেষণ করাই অপরাধ নিরাময়ের প্রধান উপায়। নিচে বাংলাদেশে অপরাধ মােকাবেলার উপায়গুলাে বর্ণনা করা হল। বাংলাদেশে অপরাধ যাতে সংঘটিত না হতে পারে তার জন্য ত্রিমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ আবশ্যক।
- প্রতিরােধমূলক ব্যবস্থা
- প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা এবং
- পুনর্বাসনমূলক ব্যবস্থা।
১। প্রতিরােধমূলক ব্যবস্থা : কথায় আছে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরােধই সর্বোত্তম ব্যবস্থা। তাই বাংলাদেশে প্রতিরােধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে নিচের পদক্ষেপগুলাে গ্রহণ করা যেতে পারে।
- অপরাধ প্রতিরােধ করতে হলে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
- বামুখী শিক্ষানীতি গ্রহণ, যাতে শিক্ষা গ্রহণের পর যােগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা থাকে।
- গণদারিদ্র্য হ্রাসের উপায় হিসেবে ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যবস্থা করতে হবে।
- অবসর যাপন ও চিত্তবিনােদনের ব্যাপক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং অপ-সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ রােধ করতে হবে।
- জনকল্যাণমুখী প্রশাসন ব্যবস্থা, পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলতে হবে।
- বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হবে। দীর্ঘসূত্রিতা কমাতে হবে।
- নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে।
২। প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা : অপরাধের মাত্রানুযায়ী উপযুক্ত শাস্তি দানের মাধ্যমে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে বাংলাদেশে অপরাধ প্রবণতা অনেকাংশে দূর করা যেতে পারে। এজন্য দেশে যেসব প্রবেশন ও প্যারােল কার্যক্রম ব্যবস্থা প্রচলিত আছে তা জোরদার করতে হবে। তাছাড়া কারা-ব্যবস্থার সংস্কার এবং বিচার-ব্যবস্থার ত্রুটি দূর করতে হবে।
৩। পুনর্বাসনমূলক ব্যবস্থা : অপরাধ ও শাতিভােগের পর মানুষ অপরাধীকে সহজভাবে গ্রহণ করতে চায় না; তাকে অপরাধী হিসেবে ঘৃণা করে। কিন্তু সেটা করা উচিত নয়। বরং যথাযথ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করলে বাংলাদেশে অপরাধ প্রবণতা হ্রাস পাবে।