বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিতে শহীদ তিতুমীরের নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে মুদ্রিত রয়েছে। তিনিই সর্বপ্রথম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে শহীদের মর্যাদা লাভ করেন। মুসলমানদের প্রতি দেশীয় জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচার, শােষণ ও অবিচার দেখে তিনি সংগ্রামী চেতনায় অনুপ্রাণিত হন। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং বাংলার অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য তিতুমীর ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হন।
তিতুমীর ১৭৮২ সালে পশ্চিমবঙ্গের চবিবশ পরগনা জেলার বারাসত মহকুমার অন্তর্গত চাঁদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হাজী নিয়ামতউল্লাহর কাছ থেকে কুরআন, হাদিস, আরবি ও ফারসি ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষালাভ করেন। তিনি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। তিনি একজন মলুযােদ্ধা ছিলেন। তিনি কিছুদিনের জন্য জমিদারদের পক্ষে প্রজাদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহের দায়িত্ব পালনকালে এক বিবাদে জড়িত হয়ে পড়েন। ফলে তাঁর জেল হয়। জেল থেকে। মুক্তি পেয়ে তিনি মক্কায় পবিত্র হজ্ব পালন করেন।
মক্কায় অবস্থানকালে তিতুমীর মুক্তিসংগ্রামের পথপ্রদর্শক সৈয়দ আহমদ শহীদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ১৮২৭ সালে দেশে ফিরে এসে সমাজসংস্কারে আত্মনিয়ােগ করেন। তিতুমীর অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। তিনি হিন্দু-মুসলমান কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করে জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে অত্রধারণে উৎসাহিত করেন। প্রথমে তিতুমীর নারিকেলবাড়িয়ায় সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কারমূলক আন্দোলন শুরু করেন।
চব্বিশ পরগনা ও নদীয়ার অনেক কৃষক তার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। অতি অল্পদিনের মধ্যে তিতুমীরের এ আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপ নেয়। তিতুমীরের জনপ্রিয়তা দেখে পূর্ণিয়ায় জমিদার কৃষ্ণদেব মুসলমান কৃষকদের দাড়ির ওপর জনপ্রতি আড়াই টাকা হারে কর আরােপ করেন। বেআইনি কর সংগ্রহে ব্যর্থ হয়ে জমিদার তিতুমীরের সমর্থকদের বাড়িঘর লুট করেন এবং মসজিদ পুড়িয়ে দেন। তিতুমীর থানায় অভিযােগ করলে অভিযােগ অগ্রাহ্য করা হয়।
তিতুমীর শান্তিপূর্ণভাবে এবং সমঝােতার মাধ্যমে প্রজাদের অত্যাচারের প্রতিকার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে প্রজাদের স্বার্থ রক্ষার্থে তিনি অত্রধারণ করেন। তিনি বারাসতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করেন। কোম্পানির বিরুদ্ধে এটাই তাঁর প্রথম বিদ্রোহ। তিনি চব্বিশ পরগনার কিছু অংশ, নদীয়া ও ফরিদপুরের একাংশ নিয়ে এক স্বাধীন রাষ্ট্র ঘােষণা করেন। তাঁকে দমন করার জন্য বারাসতের ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে প্রেরিত সশস্ত্র বাহিনী তিতুমীরের হাতে শশাচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। এ বিদ্রোহ বারাসতের বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
উইলিয়াম হান্টারের মতে, এ বিদ্রোহে ৮৩ হাজার কৃষকসেনা তিতুমীরের পক্ষে যােগদান করে। বারাসতের বিদ্রোহের পর তিতুমীর ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ অনিবার্য বুঝতে পারেন। তাই সমরপ্রস্তুতি ও সেনা প্রশিক্ষণের জন্য এবং নিজ বাহিনীর নিরাপত্তার জন্য নারিকেলবাড়িয়ায় ১৮৩১ সালে বাঁশের কেল্লা নির্মাণ এবং সেখানে যুদ্ধাস্ত্র জমা করেন। তিতুমীর তাঁর সহচর গােলাম মাসুমকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করেন। তিনি নীলকরদের কুঠি আক্রমণ করলে ভীতসন্ত্রস্ত নীলকররা সপরিবারে কলকাতায় পালিয়ে যায়।
অতঃপর কোম্পানি সরকার ১৮৩১ সালে কর্নেল স্টুয়ার্টের নেতৃত্বে পদাতিক বাহিনী, অশ্বারােহী ও বন্দুকধারী সৈন্যদের এক বিরাট বাহিনী প্রেরণ করে। ১৯ শে নভেম্বর নারিকেলবাড়িয়ায় এক ভীষণ যুদ্ধ হয়। ইংরেজদের কামান ও গােলাগুলি বর্ষণে বাঁশের কেল্লা চুর্ণ-বিচুর্ণ হয়। তিতুমীর ও তাঁর চল্লিশ জন সহচর শহীদ হন। অনেকেই বন্দী হন। বিচারে বন্দীদের বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডিত করা হয়। সেনাপতি গােলাম মাসুমকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
তিতুমীর দেশপ্রেমিক ছিলেন। তিনি নির্ভীক বীরের মতাে যুদ্ধ করে শহীদ হন। তিনি ভবিষ্যৎ স্বাধীনতাকামী সাহসী মুক্তিযােদ্ধাদের পথপ্রদর্শক হয়ে অমর হয়ে আছেন। তিতুমীরের জমিদার, নীলকর এবং ইংরেজ-বিরােধী সংগ্রাম পরবর্তীকালের সকল আন্দোলনের প্রেরণার উৎস হয়ে আছে। বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের শক্তি যুগিয়েছে এবং অনুপ্রাণিত করেছে।