হাজী শরীয়তউল্লাহর ইন্তেকালের পর তাঁর পুত্র দুদু মিয়া ফরায়েজি আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তিনি রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি এ আন্দোলনকে আরাে শক্তিশালী ও সংগঠিত করে তােলেন। দুদু মিয়া ১৮১৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। বার বছর বয়সে দুদু মিয়া শিক্ষালাভের জন্য মক্কা শরীফ গমন করেন। পাঁচ বছর পর দেশে ফিরে আসেন। তিনি ছিলেন অসাধারণ সাংগঠনিক গুণের অধিকারী।
তিনি ফরায়েজিদেরকে সংঘবদ্ধ ও সুসংহত করে তাদের মধ্যে সাহস ও আত্মবিশ্বাস জাগরিত করেন। জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবার জন্য তিনি এক শক্তিশালী লাঠিয়াল বাহিনী গঠন করেন। তিনি ফরায়েজিদের নিয়ে এক বিরাট প্রজা-আন্দোলন শুরু করেন। সংগঠনের সুবিধার্থে তিনি বাংলাদেশকে কয়েকটি অঞ্চলে বিভক্ত করেন। প্রত্যেক অঞ্চলের জন্য এক এক জন করে ‘খলিফা নিযুক্ত করেন।
ফরায়েজিদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি বৃদ্ধি, বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য অর্থ সংগ্রহ, কূটনৈতিক কলাকৌশল প্রয়ােগ ইত্যাদি খলিফাদের কাজ ছিল। নিজ নিজ অঞ্চলের সমস্ত খবরাখবর দুদু মিয়াকে নিয়মিতভাবে জানানাে ছিল খলিফাদের অপর একটি কর্তব্য।
দুদু মিয়া জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচারে জর্জরিত কৃষক, শ্রমিক, কারিগর প্রভৃতি দরিদ্র ও নির্যাতিত মানুষকে সংঘবদ্ধ করেন। তিনি তাঁর পিতার সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কারকে বৈপ্লবিক স্তরে উন্নীত করেন। তার কর্মসূচি ছিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক। ফলে এ আন্দোলনের গুণগত পরিবর্তন ঘটে। তিনি ঢাকা, পাবনা, যশাের, মালদহ, বারাসত প্রভৃতি অঞ্চলে অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। এর ফলে জমিদার, নীলকর ও ব্রিটিশ সরকার সম্মিলিতভাবে দুদু মিয়ার বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী জোট গঠন করে।
১৮৪৭ সালে তিনি এ সম্মিলিত শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। এ সংগ্রাম দমনে ব্যর্থ হয়ে সরকার দুদু মিয়াকে গ্রেপ্তার করে। ১৮৬০ সালে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। ফরায়েজি আন্দোলন প্রথমে সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার হিসেবে শুরু হলেও এটা শুধুমাত্র মুসলমান জনগণকে সংঘবদ্ধ সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেনি, আন্দোলনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি স্থানীয় হিন্দু কৃষকদের এক বিরাট অংশকে উদ্বুদ্ধ করেছিল এবং সরকারের বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এভাবে এ আন্দোলন অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনে আত্মপ্রকাশ করে।