অন্ত্র প্রতিযােগিতার নিরন্তর দৌড়ে লিপ্ত বিশ্ব। বিশ্বে প্রভাব বজায় রাখতে ক্ষমতাধর দেশগুলাের সামরিক সক্ষমতায় একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযােগিতা বেড়েই চলছে। সাম্প্রতিকালে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীন নতুন এই প্রতিযােগিতায় শামিল হয়েছে। এই দেশগুলাে ‘হাইপারসনিক’ অর্থাৎ শব্দের চেয়ে কয়েকগুণ দ্রুত গতিসম্পন্ন ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালায়। যা নিয়ে বিশ্বে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র কী?
শব্দের গতি প্রতি সেকেন্ডে ১,১২৫ ফুটের মতাে। অনেক সামরিক জেট বিমান বা অধুনাবিলুপ্ত কনকর্ডের মতাে যাত্রীবাহী বিমানও এর চেয়ে বেশি দ্রুত অর্থাৎ ‘সুপারসনিক’ গতিতে উড়তে পারে। কিন্তু একটি হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুটতে পারে শব্দের চেয়ে পাঁচ থেকে নয় গুণ বেশি গতিতে। প্রচলিত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয় রকেটের মতাে। ফলে উৎক্ষেপণ করার পর এর ট্রাজেক্টরি বা গতিপথ কী হবে তা মােটামুটি অনুমান করা যায়।
এই বিভাগ থেকে আরো পড়ুন
- বৈদ্যুতিক গাড়ির যুগে বাংলাদেশ
- বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে চুক্তি
- দেশের প্রথম স্পেশালাইজড হাসপাতাল
- কৃষকের সুরক্ষায় কিষানি ড্রোন
- দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কর্মপরিকল্পনা
- বাংলাদেশের নারী শিক্ষায় মালালা ফান্ড
- জাতীয় কৃষি কাউন্সিল গঠন
- ইউক্রেন থেকে খাদ্যশস্য রপ্তানি শুরু
- বিশ্বে প্রথম দ্বৈত টিকার অনুমােদন
- যুক্তরাজ্যে নতুন বাণিজ্যনীতি
কিন্তু হাইপারসনিক মিসাইল প্রযুক্তি একেবারেই ভিন্ন। এটি উৎক্ষেপণের পর খুব দ্রুত ওপরে উঠে আবার নেমে এসে আনুভূমিকভাবে বায়ুমণ্ডলের মধ্যেই চলতে থাকে, গতিপথও পরিবর্তন করতে পারে। এর অর্থ এটি কোনদিকে যাবে তা আগে থেকে অনুমান করা সম্ভব নয়। তাই তা মাঝপথে ধ্বংস করা প্রায় অসম্ভব। আর এ মুহূর্তে বিশ্বে অস্ত্র প্রতিযােগিতার মূলকেন্দ্রে রয়েছে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র।
প্রতিযােগিতার সূচনা
স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকেই যুক্তরাজ্য ও রাশিয়া Fractional Orbital Bombardment System (FOBS) নিয়ে গবেষণা করছে, আর ১৯৭০-এর দশকে এ রকম একটি পদ্ধতি চালু করেও ১৯৮০-র দশকে তা বন্ধ করে দেয় রাশিয়া। FOBS পদ্ধতিতে ক্ষেপণাস্ত্র পাঠানাে হয় আংশিকভাবে পৃথিবীর কক্ষপথে, যাতে অপ্রত্যাশিত কোনাে স্থান থেকে তা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে।
২০১৮ সালে রাশিয়া দাবি করে, তারা একেবারে নতুন ধরনের একটি হাইপারসনিক ক্ষেপণায় উদ্ভাবন করেছে। যার নাম Avangard হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র। এটি চলে শব্দের চেয়ে ২০ গুণ বেশি গতিতে। ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮ রাশিয়া পরীক্ষামূলকভাবে এ নতুন ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালায়।
মূলত এরপর থেকেই হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ও তৈরির প্রতিযােগিতা শুরু হয়। বর্তমান বিশ্বে অন্তত আটটি দেশ হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চীন সবচেয়ে উন্নত হাইপারসনিক অস্ত্র কর্মসূচির অধিকারী আর অস্ট্রেলিয়া, ভারত, ফ্রান্স, জার্মানি এবং জাপান হাইপারসনিক অস্ত্র প্রযুক্তির উন্নয়ন করছে।
ICBM ও হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের পার্থক্য
আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (Intercontinental Ballistic Missile ICBM) হলাে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, যা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল থেকে বেরিয়ে ছুটতে পারে, আবার পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারে। এ ক্ষেপণাস্ত্র পরাবৃত্তাকার গতিপথ ধরে নিশানার দিকে ছােটে। এখন যে ধরনের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রচলিত, সেগুলাে ছোড়া হয় রকেটের মতাে। ফলে একবার উৎক্ষেপণ করার পর এর Trojectory বা সম্ভাব্য গতিপথ মােটামুটি অনুমান করা যায়। শত্রুপক্ষ তখন সে অনুযায়ী তাদের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা দিয়ে ধ্বংসের চেষ্টা করতে পারে।
অন্যদিকে, হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ICBM’র চেয়েও দ্রুতগতিতে চলে। আকৃতি ভিন্ন হওয়ায় এটি আঁকাবাঁকা পথে প্রতিরক্ষা ব্যুহকে এড়িয়ে আঘাত হানতে পারে, যা CISM পারে না। আর এগুলােকে ট্র্যাকিং বা চিহ্নিত করাও কঠিন। সাধারণ ক্ষেপণাস্ত্র এবং গাইড ভেহিকল বা ইঞ্জিনবিহীন বিমানের সমন্বয় ঘটিয়ে এমনভাবে এই হাইপারসনিক মিসাইল তৈরি করা হয়েছে, যাতে এটা নিক্ষেপের পর মহাশূন্যে উঠে আংশিকভাবে পৃথিবীর কক্ষপথে পৌছে যেতে পারে।
Next Big Thing
বেশিরভাগ ক্ষেপণাস্ত্রের মাথায় একটা বােমা বা বিস্ফোরক বসানাে থাকে যাকে বলা হয় ওয়ারহেড। হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রে ওয়ারহেড হিসেবে পারমাণবিক বােমা বসানাের সুযােগ রয়েছে, ফলে এ অস্ত্র হতে যাচ্ছে। আন্তঃমহাদেশীয় যুদ্ধের এক মােড়বদলকারী সংযােজন বা Next Big Thing (NBT)। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলাে প্রতি সেকেণ্ডে পাচ মাইল পর্যন্ত গতিতে ছুটতে পারবে, উপগ্রহগুলাে থেকে আসা সতর্ক সংকেতকে বােকা বানাতে পারবে, একে মাঝপথে বাধা দেওয়ার মতাে প্রতিপক্ষের যেকোনাে যন্ত্র বা ক্ষেপণাস্ত্রকেও ফাঁকি দিতে পারবে। হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা।
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
২৬ ডিসেম্বর ২০১৮ : রাশিয়া পরীক্ষামূলকভাবে Avangard হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালায়।
১ অক্টোবর ২০১৯ : চীন ডিএফ-১৭ নামের একটি হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র উন্মােচন করে।
৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ : ভারত হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালায়।
জুলাই ২০২১ : রাশিয়া প্রথমবারের মতাে সাবমেরিন থেকে উৎক্ষেপণযােগ্য জিরকন ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালায়।
আগস্ট ২০২১ : চীন FOBS পদ্ধতিতে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালায়।
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ : যুক্তরাষ্ট্র মাক ৫ নামে একটি হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করে। এটি ছিল শব্দের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি দ্রুতগতিসম্পন্ন।
৪ অক্টোবর ২০২১ : রাশিয়া পারমাণবিক সাবমেরিন থেকে জিরকন হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের পরীক্ষা সফলভাবে সম্পন্ন করে।