বিশ্বজুড়ে বিচিত্র মন্ত্রণালয়

নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যপদ সৌদি আরব কর্তৃক প্রত্যাখ্যানের কারণগুলাে আলােচনা করুন।

উত্তর : জাতিসংঘের ৬টি অঙ্গ সংস্থার অন্যতম একটি নিরাপত্তা পরিষদ, যার অপর নাম স্বস্তি পরিষদ। ১৯৪৬ সালে ১১টি সদস্য নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদ গঠিত হলেও ১৯৬৫ সালে জাতিসংঘ সনদ সংশােধন করে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য ১১টি থেকে বাড়িয়ে ১৫টি করা হয়। এর মধ্যে ৫টি স্থায়ী এবং ১০টি অস্থায়ী সদস্য। নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য দেশগুলাে সাধারণ পরিষদ কর্তৃক দুই বছর মেয়াদে নির্বাচিত হয়। ১৭ অক্টোবর ২০১৩ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য নির্বাচিত হয় সৌদি আরব।

নির্বাচিত হওয়ার পরদিন ১৮ অক্টোবর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যপদ প্রত্যাখ্যান করে এক নজিরবিহীন ঘটনার জন্ম দেয় দেশটি। বিশ্ব রাজনীতিতে ক্রমাগত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সদস্যপদ প্রত্যাখ্যানের সিদ্ধান্ত নেয়। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, সবার আগে প্রয়ােজন জাতিসংঘের সংস্কার । দীর্ঘদিনের ফিলিস্তিন সমস্যা, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যকে গণবিধ্বংসী অস্ত্রমুক্ত করাসহ বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘের ব্যর্থতা ও নিষ্ক্রিয়তা এবং দ্বিমুখী নীতির কারণে সৌদি কর্তৃপক্ষ এমন ঘােষণা দেয়। নিরাপত্তা পরিষদের ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করে সৌদি কর্তৃপক্ষ জানায়, এর জন্য বিশ্বসভার সর্বোচ্চ এ পরিষদের অসম নীতি দায়ী।

তবে সৌদি আরবের এমন হতাশা নতুন বা আকস্মিক নয়। বরং বহু বছর ধরে পুঞ্জীভূত হতাশার দ্বিতীয় বহিঃপ্রকাশ। এর আগে একই ধরনের হতাশা ব্যক্ত করে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ভাষণ দিতে অস্বীকৃতি জানান সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স সৌদ আল ফয়সাল। সৌদি আরবের এ হতাশা তৈরি হয়েছে বিভিন্ন কারণে। শিয়া অধ্যুষিত দেশ ইরান ও সিরিয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন মােটেই পছন্দ নয় সৌদি আরবের। ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের জের ধরেই হয়তাে কথা ছিল ইরানকে যেভাবেই হােক কোণঠাসা করে রাখার।

ইরান ও ইসরাইলকে ইঙ্গিত করে সৌদি আরবের অভিযােগ, মধ্যপ্রাচ্যকে পরমাণু অস্ত্রসহ গণবিধ্বংসী অস্ত্রমুক্ত করার ক্ষেত্রেও চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে নিরাপত্তা পরিষদ। একই সাথে বিগত ৬৭ বছর ধরে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান না হওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যে একাধিকবার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। অমীমাংসিত ও স্পর্শকাতর এ বিষয় এখনও বিশ্ব শান্তির জন্য হুমকি। এক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে জাতিসংঘ। মধ্যপ্রাচ্য সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এ ব্যর্থতার কারণ হিসেবে সৌদি আরব দায়ী করছে ‘ইন্টারন্যাশনাল ডাবল স্ট্যান্ডার্ডস’ বা আন্তর্জাতিক বৈষম্য নীতিকে। ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে ইসরাইল সেখানে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলেও অবহেলিত থেকে গেছে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বৈষম্য নীতির কারণে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এ ইস্যুতে সীমাহীন দীর্ঘ শান্তি আলােচনা। জাতিসংঘের এমন ব্যর্থতায় ক্ষোভ যেন শেষ সীমায় পৌছেছে সৌদি আরবসহ গােটা আরব বিশ্বের। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, সৌদি আরবের অভিযােগ মূলত যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধে। কারণ বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্রের জন্য তাদের মায়াকান্না দেখা গেলেও ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার পক্ষে তাদের প্রতিশ্রুতির কোনাে বাস্তবায়ন নেই। ফিলিস্তিন সমস্যার সাথে জড়িত আছে ইরান ও সিরিয়া ইস্যু। ঐ অঞ্চলে ইরানের উত্থান।

স্বাভাবিকভাবেই সৌদি আরবের জন্য মাথা ব্যথার কারণ। যুক্তরাষ্ট্রের গানে ঠোঁট মেলানাে ছাড়া তার কোনাে উপায় নেই। তাই ইরানই ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানে মূল প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হিসেবে কার্যকরী ভূমিকা রাখছে। একদিকে লেবাননের শিয়া গেরিলা গােষ্ঠী হিজবুল্লার সাথে ইরানের সখ্যতা, অন্যদিকে সিরিয়ার শিয়া একনায়ক বাশার আল আসাদের সাথে দহরম মহরম সম্পর্কের কারণে অস্বস্তিতে সৌদি আরব। অনেকে মনে করছেন, পরমাণু ইস্যুতে ইরানকে শায়েস্তা না করে যুক্তরাষ্ট্রের আলােচনায় যাওয়ার পদ্ধতিটা সম্ভবত সৌদি কর্তৃপক্ষের পছন্দ হয়নি।

সৌদি আরব সিরিয়ার বিদ্রোহীদের পূর্ণ সমর্থন ও সহায়তা দিয়ে আসলেও শেষ মুহূর্তে দামেস্ক ও তেহরানকে কোণঠাসা করার সে উপায়টাও যেন হাতছাড়া হয়ে যায়। লক্ষাধিক মানুষ হত্যা করলেও আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে কোনাে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ নিরাপত্তা পরিষদ। বরং রাসায়নিক অস্ত্র সমর্পণের প্রস্তাব দিয়ে সব কিছুই যেন ভণ্ডুল হয়ে গেলাে। রাতারাতি খলনায়ক থেকে নায়কে পরিণত হলেন প্রেসিডেন্ট আসাদ। এসব কারণে সৌদি কর্তৃপক্ষ মনে করছে, সবার আগে নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কার হওয়া প্রয়ােজন।

মূলত জাতিসংঘের এ সংস্কার চায় নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য ছাড়া অনেকেই। স্থায়ী সদস্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ফ্রান্স ও চীনের আশঙ্কা বহু আকাক্ষিত সংস্কার হলে বিশ্ব ক্ষমতার ভারসাম্য ও ধারাবাহিকতা নষ্ট হবে। তার ফলশ্রুতিতে বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন খেলােয়াড়ের আমদানি ঘটবে। আর এর ফলে জাতিসংঘ নিজেই তার। বৈধতা ও নিযােগ্যতা হারিয়ে ফেলবে। সৌদি আরবের রাজনৈতিক ঐতিহ্য হলাে ঘটনার পিছনে থেকে কলকাঠি নাড়ানাে। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বাড়াতে এভাবেই নিজের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য হাসিল করে থাকে দেশটি। বিশেষ করে জি-টুয়েন্টির সদস্য হিসেবে গত কয়েক বছরে বিশ্ব রাজনীতিতে নিজের অবস্থান আরাে জোরদার করতে সক্ষম হয় যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ঘনিষ্ঠ মিত্র সৌদি আরব।

Related Post