আমাদের সকল পোস্ট ও ভিডিও হোয়াটসঅ্যাপে পেতে ফলো করুন :

Click Here
সামাজিক বিজ্ঞান

পরিবারের সংজ্ঞা, পরিবারের প্রকারভেদ ও পরিবারের কার্যাবলি

পরিবার হল সমাজের ক্ষুদ্রতম মানবগােষ্ঠী। গােষ্ঠীজীবনের প্রথম ধাপই হল পারিবারিক জীবন। প্রত্যেকটি মানুষ একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করে। এমন কোনাে মানবসমাজের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না যেখানে পরিবার-প্রথা নেই। পরিবার হল একটি ক্ষুদ্রতম সামাজিক সংগঠন যেখানে পিতা-মাতা ও তাদের সন্তান-সন্ততি একত্রে বসবাস করে।

পরিবারের সংজ্ঞা

অধ্যাপক নিমকফ পরিবারের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, “পরিবার হচ্ছে মােটামুটিভাবে স্থায়ী এমন একটি সংঘ যেখানে সন্তানাদিসহ বা সন্তানাদি ছাড়া স্বামী-স্ত্রী একত্রে বসবাস করে।” সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার বলেন, “পরিবার হল একটি গােষ্ঠী যা সন্তান উৎপাদন ও প্রতিপালনের জন্য সুনির্দিষ্ট এবং স্থায়ী স্ত্রী-পুরুষের সম্পর্কের দ্বারা নির্ধারিত হয়।”

পরিবার কিভাবে গঠিত হয়

বিবাহ হল পরিবার গঠনের অন্যতম পূর্বশর্ত। একজন পুরুষ সমাজহ্বীকৃত উপায়ে এক জন স্ত্রীলােককে বিয়ে করে একটি একক পরিবার গঠন করে। তবে আদিম সমাজে বিবাহ ব্যতিরেকেই পরিবার গঠিত হত। কিন্তু আমাদের সমাজে এটা সম্ভব নয়। এমন পরিবার অজানা নয় যেখানে পিতৃমাতৃহীন ভাই-বােন অথবা মা ও মেয়ে বা ছেলে অথবা বাবা তার অবিবাহিত ছেলে বা মেয়ে অথবা দাদা তার নাতি বা নাতনি নিয়ে পরিবার গঠন করছে। সুতরাং বলা যায় যে, বিবাহের মাধ্যমে অথবা বিবাহ না করেও পরিবার গঠন করা যায়।

পরিবারের প্রকারভেদ

পরিবার বিশ্বজনীন প্রতিষ্ঠান হলেও সমাজ-ভেদে বা দেশ-ভেদে পরিবারের রূপ ভিন্নরকম হয়। অর্থাৎ বিভিন্ন মাপকাঠির ভিত্তিতে পরিবারকে বিভিন্নভাবে বিভক্ত করা হয়ে থাকে। নিম্নে বর্ণনা করা হল।

আরো পড়ুন : সামাজিকীকরণ কি ? সামাজিকীকরণের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমগুলো কি কি?

(১) স্বামী-স্ত্রীর সংখ্যার ভিত্তিতে পরিবারকে ৩ ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-

  • এক বিবাহ পরিবার
  • বহুপত্নীক পরিবার
  • বহুপতি পরিবার
এক বিবাহ পরিবার :

একজন পুরুষ একই সময়ে শুধুমাত্র একজন স্ত্রীলােককে বিয়ে করে যে পরিবার গঠন করে তাকে এক বিবাহভিত্তিক পরিবার বলে। আধুনিক সভ্য সমাজে এ ধরনের পরিবার বেশি পরিলক্ষিত হয়। এ ধরনের পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কর্তৃত্বের নয় বরং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দেখা যায়।

বহুপত্নীক পরিবার :

একজন পুরুষের সঙ্গে একই সময়ে একাধিক স্ত্রীলােকের বিবাহের মাধ্যমে যে পরিবার গঠিত হয় তাকে বতুপত্নীক পরিবার বলে। সাধারণত কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ মুসলিম সমাজে এ ধরনের বহুপত্নীক পরিবার দেখা যায়। আবার যেসব সমাজে পুরুষের তুলনায় স্ত্রীলােকের সংখ্যা বেশি সেখানে বহুপত্নীক পরিবার বেশি দেখা যায়।

বহুপতি পরিবার :

যখন একজন স্ত্রীলােকের একই সময়ে একাধিক পুরুষের সঙ্গে বিবাহ হয়ে পরিবার গড়ে ওঠে তখন সে পরিবারকে বহুপতি পরিবার বলে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এ পরিবারের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। ভারতের টোডা উপজাতিদের মধ্যে এ ধরনের পরিবার দেখা যায়।

(২) পরিবারের কর্তৃত্ব বা ক্ষমতা কার ওপর ন্যস্ত তার ওপর ভিত্তি করে পরিবারকে ২ ভাগে ভাগ করা হয়। যথা-

  • পিতৃপ্রধান পরিবার
  • মাতৃপ্রধান পরিবার
পিতৃপ্রধান পরিবার :

পরিবারের কর্তৃত্ব যদি পিতা-স্বামী বা বয়স্ক কোনাে পুরুষের হাতে থাকে তখন সে পরিবারকে পিতৃপ্রধান পরিবার বলে। পিতা এ পরিবারের সকল সম্পত্তির মালিক এবং তিনিই পরিবারের শাসনকর্তা। বাংলাদেশে হিন্দু ও মুসলিম পরিবার হল পিতৃপ্রধান পরিবার।

মাতৃপ্রধান পরিবার :

যখন পরিবারের কর্তৃত্ব মাতা, স্ত্রী বা বয়স্কা কোনাে মহিলার ওপর ন্যস্ত হয় তখন সে পরিবারকে মাতৃপ্রধান পরিবার বলে। এ পরিবারে নেতৃত্ব দেন মাতা বা বয়স্কা কোনাে মহিলা। এ পরিবারে সম্পত্তির মালিকানা মেয়েদের হাতে ন্যত। বাংলাদেশের গারাে নৃতাত্ত্বিক গােষ্ঠীর মধ্যে মাতৃপ্রধান পরিবার দেখা যায়।

(৩) বিবাহ-উত্তর বাসস্থানের ওপর ভিত্তি করে পরিবারকে ৩ ভাগে বিভক্ত করা হয়। যথা-

  • পিতৃবাস পরিবার
  • মাতৃবাস পরিবার
  • নয়াবাস পরিবার
পিতৃবাস পরিবার :

বিবাহের পর স্বামী যদি নিজের পিতার গৃহে স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করে তাহলে তাকে পিতৃবাস পরিবার বলে। বাংলাদেশে মুসলিম ও হিন্দু সমাজের পরিবার হল পিতৃবাস।

আরো পড়ুন :

মাতৃবাস পরিবার :

বিবাহের পর স্বামী যদি স্ত্রীর মাতার গৃহে বসবাস করে তাহলে তাকে মাতৃবাস পরিবার বলে। বাংলাদেশে গারাে সমাজে এ ধরনের পরিবার দেখা যায়।

নয়াবাস পরিবার :

নয়াবাস পরিবারের ক্ষেত্রে বিবাহিত নবদম্পতি তাদের পিতার বা মাতার গৃহে বাস না করে সম্পূর্ণভাবে তাদের নিজেদের (দম্পতি) বাড়িতে বসবাস করে তাকে নয়াবাস পরিবার বলা হয়। আমাদের দেশে শহরাঞ্চলে নয়াবাস পরিবার দেখা যায়।

(৪) বংশ গণনার ওপর ভিত্তি করে পরিবারকে ২ ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যথা-

  • পিতৃ-বংশানুক্রমিক পরিবার
  • মাতৃ-বংশানুক্রমিক পরিবার
পিতৃ-বংশানুক্রমিক পরিবার :

পিতার বংশানুসারে বংশ গণনা করা হয় যে পরিবারে সে পরিবারকে পিতৃ-বংশানুক্রমিক পরিবার বলে। এ পরিবারে বংশনাম, বংশমর্যাদা, উপাধি এবং সম্পত্তির উত্তরাধিকার প্রভৃতি পিতৃধারায় বর্তায়। বাংলাদেশের হিন্দু ও মুসলমান পরিবার হল পিতৃ-বংশানুক্রমিক পরিবার।

মাতৃ-বংশানুক্রমিক পরিবার :

মাতার বংশানুসারে বংশগণনা করা হয় যে পরিবারে সে পরিবারকে মাতৃ বংশানুক্রমিক পরিবার বলা হয়। এ পরিবারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল বংশমর্যাদা, উত্তরাধিকার, উপাধি সবকিছুই মাতৃধারায় প্রবর্তিত হয়। বাংলাদেশের গারাে সমাজে এ ধরনের পরিবার দেখা যায়।

(৫) পরিবারের আকারের ভিত্তিতে পরিবারকে ৩ ভাগে ভাগ করা হয়। যথা-

  • অণু পরিবার
  • বর্ধিত পরিবার এবং
  • যৌথ পরিবার
অণু পরিবার :

অণু পরিবার গঠিত হয় সাধারণত স্বামী-স্ত্রী এবং অবিবাহিত এক বা একাধিক সন্তান-সন্ততি নিয়ে। এ পরিবার দুইপুরুষে আবদ্ধ, এ দুইপুরুষ হল পিতা এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তান-সন্ততি।

বর্ধিত পরিবার :

বর্ধিত পরিবারে অন্তর্ভুক্ত হয় স্বামী-স্ত্রী, অবিবাহিত ও বিবাহিত পুত্র কন্যা; পৌত্র ও পৌত্রীগণ। কমপক্ষে ৩ পুরুষের পরিবার হল বর্ধিত পরিবার। বাংলাদেশে গ্রামীণ কৃষি সমাজে এ ধরনের পরিবার দেখা যায়।

যৌথ পরিবার :

যৌথ পরিবার হল কয়েকটি একক পরিবারের সমষ্টি। যৌথ পরিবারে বিবাহিত পুত্র ও তার সন্তানাদিসহ পিতামাতার কর্তৃত্বাধীন এক সংসারে বাস করে। সবাইকে পরিবারের নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। এখানে কেউ ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিক হতে পারে না। অর্থনৈতিক দায়দায়িত্ব সবাই ভাগাভাগি করে নেয়।

পরিবারের কার্যাবলি

সমাজের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় পরিবারের প্রয়ােজনীয়তা ও গুরুত্ব সর্বাধিক। সুতরাং সমাজজীবনের ওপর এর প্রভাবও বেশি। সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিবার নিম্নলিখিত কার্যাবলি সম্পাদন করে। যথা

  • জৈবিক কাজ : নরনারীর জৈবিক ও দৈহিক প্রয়ােজন মেটানাে পরিবারের অন্যতম প্রধান কাজ। বিয়ের মাধ্যমে পরিবার তার সদস্যদের জৈবিক চাহিদা পূরণ করে।
  • সন্তান উৎপাদন ও লালন-পালন কী : সন্তান উৎপাদনের একমাত্র স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান হল পরিবার। জন্মের পর শিশুকে লালন-পালন করে একজন আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তােলার দায়িত্ব পরিবারের।
  • সামাজিকীকরণ : শিশুর চরিত্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় পরিবারেই। শিশুকাল হতে একটি শিশু সমাজের রীতিনীতি, আচার-ব্যবহার, নিয়ম-কানুন, অভ্যাস প্রভৃতি পরিবার হতে শিক্ষালাভ করে। পরিবারে সুন্দর পরিবেশ থাকা বাঞ্ছনীয়। পরিবারের সুন্দর পরিবেশ ছাড়া শিশুর সামাজিকীকরণ সঠিকভাবে সম্পন্ন হয় না।
  • অর্থনৈতিক কাজ : পরিবারের সদস্যদের অর্থনৈতিক চাহিদা তথা তাদের অন্যান্য চাহিদা মেটানাের দায়িত্ব হল পরিবারের। এমন একসময় ছিল যখন পরিবারই ছিল যাবতীয় অর্থনৈতিক কার্যকলাপের কেন্দ্রবিন্দু। তখন পরিবারের যাবতীয় প্রয়ােজনীয় বস্তুগুলাে গৃহেই উৎপাদিত হত। এজন্যই পরিবারকে উৎপাদনের একক বলা হত (Unit of Production)। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবারের অর্থনৈতিক কাজগুলাে মিল, কারখানা, দোকান, বাজার, ব্যাংক এসব প্রতিষ্ঠানগুলাে কৃতিত্বের সঙ্গে সম্পাদন করছে। এখন পরিবারের সদস্যরা ঘরের বাইরে কাজ করে অর্থ উপার্জনের জন্য। এজন্য পরিবারকে বর্তমানে আয়ের একক (Unit of Income) বলা হয়।
  • শিক্ষামূলক কাজ : গৃহ শিশুদের অন্যতম উল্লেখযােগ্য শিক্ষা কেন্দ্র। জন্মের পর শিশু গৃহেই প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে। যদিও বর্তমানে শিক্ষা দেওয়ার যাবতীয় দায়িত্ব গ্রহণ করেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তবুও আচার-ব্যবহার, নিয়মানুবর্তিতা, নৈতিকতা ও ধর্মীয় বিষয়গুলাে শিশুরা গৃহেই শিক্ষালাভ করে।
  • ধর্মীয় কাজ : শিশুর নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা এক সময়ে পরিবারের ওপরই ন্যস্ত ছিল। কিন্তু বর্তমানে এ কাজটা গ্রহণ করেছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ। তবে একথা ঠিক সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে এবং নৈতিকতা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা শিশু নিজ গৃহেই লাভ করে।
  • নিরাপত্তামূলক কাজ : সবরকম বিপদ-আপদ, অসুখবিসুখ হতে পরিবারের সদস্যদের রক্ষা করার দায়িত্ব পরিবারের। যদিও বর্তমানে পরিবারের নিরাপত্তামূলক কাজের মাত্রা অনেকটা হ্রাস পেয়েছে তবুও পরিবার তার সদস্যদের শারীরিক ও নৈতিক নিরাপত্তা দিয়ে থাকে।
  • বিনােদনমূলক কাজ : এমন একসময় ছিল যখন গৃহই ছিল সব রকম আমােদ-প্রমোেদ বা বিনােদনের কেন্দ্রস্থল। কিন্তু শিল্পসভ্যতা প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে আমােদ-প্রমােদের কাজগুলাের জন্য সৃষ্টি হয়েছে নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান। তবুও পরিবারিক পরিমণ্ডলে সকল সদস্যের মিলেমিশে বনভােজন করা, কোনাে দর্শনীয় স্থানে বেড়াতে যাওয়া, ঘরে বসে টিভি, ভিসিআর দেখা, কারও জনাৎসব করা প্রভৃতি কাজগুলাে এখনাে পরিবার সম্পাদন করে।

সাম্প্রতিককালে পরিবারের কার্যাবলির অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। পরিবারের অর্থনৈতিক, শিক্ষামূলক, ধর্মীয়, নিরাপত্তা ও বিনােদনমূলক কাজের জন্য সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন ধরনের প্রথা-প্রতিষ্ঠান। তবে সন্তান উৎপাদন, লালনপালন করা বিশেষ করে শিশুর সামাজিকীকরণের মতাে কাজে পরিবারের গুরুত্ব অসীম।

Md. Mahabub Alam

I am a committed educator, blogger and YouTuber and I am striving to achieve extraordinary success in my chosen field. After completing Masters in Anthropology from Jagannath University, I am working as Chief Accounts Officer in a national newspaper of the country. I really want your prayers and love.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button