![সাম্প্রতিক সাধারণ জ্ঞান বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী](https://bcspreparation.net/wp-content/uploads/2022/11/bcs-preparation-1-780x470.png)
পৃথিবীতে যত ধরনের তরল পদার্থ পাওয়া যায়, পানি তার মাঝে সবচেয়ে সহজলভ্য। মানুষের শরীরের শতকরা ৬০-৭৫ ভাগই হচ্ছে পানি। মাছ, মাংস কিংবা শাক-সবজিতে শতকরা ৬০-৯০ ভাগ পানি থাকে। পৃথিবীপৃষ্ঠের শতকরা ৭৫ ভাগই হচ্ছে পানি। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য পানি অপরিহার্য, তাই পানির আরেক নাম হচ্ছে জীবন। তাহলে পানির কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধর্ম সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
পানির ধর্ম
গলনাংক ও স্ফুটনাংক। তােমাদের কি মনে আছে, পানির গলনাংক আর স্ফুটনাংক কত? পানি যখন কঠিন অবস্থায় থাকে সেটিকে আমরা বলি বরফ। যে তাপমাত্রায় বরফ গলে যায়, সেটিই হচ্ছে বরফের গলনাংক। বরফের গলনাংক ০° সেলসিয়াস। অন্যদিকে বায়ুমণ্ডলীয় চাপে যে তাপমাত্রায় তরল পদার্থ বাষ্পে পরিণত হয়, তাকে বলে স্ফুটনাংক। পানির স্ফুটনাংক ৯৯.৯৮° সেলসিয়াস যেটা ১০০° সেলসিয়াসের খুবই কাছাকাছি।
তাই সাধারণভাবে আমরা পানির স্ফুটনাংক ১০০° সেলসিয়াস বলে থাকি। বিশুদ্ধ পানি স্বাদহীন, গন্ধহীন আর বর্ণহীন। তােমরা কি জান পানির ঘনত্ব কত? পানির ঘনত্ব তাপমাত্রার ওপর নির্ভর করে। ৪° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পানির ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি আর সেটি হচ্ছে ১ গ্রাম/সি.সি বা ১০০০ কেজি/মিটার কিউব। অর্থাৎ ১ সি.সি. পানির ভর হলাে ১ গ্রাম বা ১ কিউবিক মিটার পানির ভর হলাে ১০০০ কেজি।
বিদ্যুৎ বা তড়িৎ পরিবাহিতা
বিশুদ্ধ পানিতে বিদ্যুৎ বা তড়িৎ পরিবাহিত হয় না, তবে এতে লবণ কিংবা এসিডের মতাে তড়িৎ বিশ্লেষ্য পদার্থ দ্রবীভূত থাকলে তড়িৎ পরিবাহিত হয়। পানির একটি বিশেষ ধর্ম হলাে এটি বেশির ভাগ অজৈব যৌগ আর অনেক জৈব যৌগকে দ্রবীভূত করতে পারে। এজন্য পানিকে সর্বজনীন দ্রাবকও বলা হয়।
পানি একটি উভধর্মী পদার্থ অর্থাৎ কখনাে এসিড, কখনাে ক্ষার হিসেবে কাজ করে। সাধারণত এসিডের উপস্থিতিতে পানি ক্ষার হিসেবে আর ক্ষারের উপস্থিতিতে এসিড হিসেবে কাজ করে। তবে বিশুদ্ধ পানি পুরােপুরি নিরপেক্ষ অর্থাৎ এর pH হলাে ৭, যেটি সম্পর্কে আমরা সপ্তম অধ্যায়ে বিস্তারিত আলােচনা জানব।
পানির গঠন
তােমাদের মনে কি প্রশ্ন জেগেছে যে আমাদের জীবনের জন্য অপরিহার্য এই পানি কী দিয়ে তৈরি? পানি * দুইটি হাইড্রোজেন পরমাণু আর একটি অক্সিজেন পরমাণু (চিত্র ২.০১) দিয়ে গঠিত। তাই আমরা রসায়ন এ পড়ার সময় পানিকে H,O লিখি অর্থাৎ এটিই হলাে পানির সংকেত। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে এখন আমরা জানি যে আমরা যে পানি দেখি সেখানে অনেক পানির অণু একসাথে ক্লাস্টার (Cluster) হিসেবে থাকে।
পানির উৎস
তােমরা কি বলতে পারবে আমাদের অতি দরকারি এই পানি আমরা কোন উৎস থেকে পাই? পানির সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে সাগর, মহাসাগর বা সমুদ্র। পৃথিবীতে যত পানি আছে, তার প্রায় শতকরা ৯০ ভাগেরই উৎস হচ্ছে সমুদ্র। সমুদ্রের পানিতে প্রচুর লবণ থাকে এজন্য সমুদ্রের পানিকে লােনা পানিও (Marine water) বলে। লবণের কারণে সমুদ্রের পানি পানের অনুপযােগী, এমনকি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অন্য কাজেও সমুদ্রের পানি ব্যবহার করা যায় না।
পানির আরেকটি বড় উৎস হলাে হিমবাহ তুষার স্রোত, যেখানে পানি মূলত বরফ আকারে থাকে। এই উৎসে প্রায় শতকরা ২ ভাগের মতাে পানি আছে। উল্লেখ্য যে বরফ আকারে থাকায় এই পানিও কিন্তু অন্য কাজে ব্যবহারের উপযােগী নয়। ব্যবহার উপযােগী পানির উৎস হলাে নদ-নদী, খাল-বিল, হ্রদ, পুকুর কিংবা ভূগর্ভস্থ পানি। ভূগর্ভস্থ পানি আমরা নলকূপের মাধ্যমে তুলে আনি। পাহাড়ের উপর জমে থাকা বরফ বা তুষার গলেও ঝর্ণা সৃষ্টি করতে পারে। লক্ষণীয় ব্যাপার হলাে, পৃথিবীতে ব্যবহারের উপযােগী পানি মাত্র শতকরা ১ ভাগ।
বাংলাদেশে মিঠা পানির উৎস
আমরা আমাদের বাসায় রান্না থেকে শুরু করে কাপড় ধােয়া, গােসল কিংবা খাওয়ার পানি কোথা থেকে পাই? মাঠে ফসল ফলাতে কখনাে কখনাে (যেমন: ইরি ধানের জন্য) প্রচুর পরিমাণে পানির দরকার হয়। এ পানিই বা আমরা কোথা থেকে পাই? আমাদের দেশে ঝর্ণা তেমন একটা না থাকায় মিঠা পানির মূল উৎস হচ্ছে নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর, হ্রদ এবং ভূগর্ভের পানি। তবে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ বিশেষ করে আর্সেনিক থাকায় বাংলাদেশের বিস্তৃত এলাকার ভূগর্ভের পানি পানের অনুপযােগী হয়ে পড়েছে। তাই ঐ সকল এলাকার মানুষ বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করার পর পরিশােধন করে সেটি পান করতে বাধ্য। হয়েছে।
জলজ উদ্ভিদের জন্য পানির প্রয়ােজনীয়তা
তােমরা কচুরিপানা, ক্ষুদিপানা, ওড়িপানা, সিংগারা, টোপাপানা, শাপলা, পদ্ম, শ্যাওলা, হাইড্রিলা, কলমি, হেলেঞ্চা, কেশরদাম ইত্যাদি নানা রকম জলজ উদ্ভিদের নাম শুনেছ এবং তাদের অনেকগুলাে নিজের চোখেও দেখেছ। এরা কোথায় জন্মে জান? এদের বেশির ভাগই পানিতে জন্মে এবং কিছু কিছু আছে (যেমন: কলমি, হেলেঞ্চা, কেশরদাম) যারা পানিতে আর মাটিতে দুজায়গাতেই জন্মে।
অর্থাৎ পানি না থাকলে বেশির ভাগ জলজ উদ্ভিদ জন্মাতই না, কিছু কিছু হয়তাে জন্মাতাে কিন্তু বাঁচতে পারত কিংবা বেঁচে থাকলেও বেড়ে উঠতে পারত না। তখন কী হতাে? তখন পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটত। তার কারণ, এই জলজ উদ্ভিদগুলাে একদিকে যেমন সালােকসংশ্লেষণের মাধ্যমে অক্সিজেন তৈরি করে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা ঠিক রাখে, অন্যদিকে এদের অনেকগুলাে বিশেষ করে শ্যাওলাজাতীয় জলজ উদ্ভিদগুলাে জলজ প্রাণীদের খাদ্যভাণ্ডার হিসেবে কাজ করে।
এসব জলজ উদ্ভিদ না থাকলে মাছসহ অনেক জলজ প্রাণী বাঁচতেই পারত না, যেটি পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হতাে। তােমরা জান যে উদ্ভিদগুলাে সাধারণত মূলের মাধ্যমে পানি আর অন্যান্য প্রয়ােজনীয় উপাদান সংগ্রহ করে। কিন্তু জলজ উদ্ভিদগুলাে সারা দেহের মাধ্যমেই পানিসহ অন্যান্য প্রয়ােজনীয় উপাদান বিশেষ করে খনিজ লবণ সংগ্রহ করে থাকে। তাই এদের পুরাে দেহ পানির সংস্পর্শে না এলে এদের বেড়ে ওঠাই হতাে না।
আরেকটি লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে জলজ উদ্ভিদের কাণ্ড আর অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ খুব নরম হয়, যেটা পানির স্রোত আর জলজ প্রাণীর চলাচলের সঙ্গে মানানসই। পানি ছাড়া শুকনাে মাটিতে এদের জন্ম হলে এরা ভেঙে পড়ত এবং বেড়ে উঠতে পারত না এমনকি বাঁচতেও পারত না। তােমরা কি জান জলজ উদ্ভিদ কীভাবে বংশবিস্তার করে? জলজ উদ্ভিদগুলাে সাধারণত অঙ্গজ উপায়ে বংশবিস্তার করে।
পানি না থাকলে এই বংশবিস্তার বাধাগ্রস্ত হতাে। তাই আমরা বলতে পারি, আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য জলজ উদ্ভিদগুলাের জন্ম খুবই জরুরি এবং তাদের বেড়ে উঠার জন্য পানির ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। পানি না থাকলে জলজ উদ্ভিদগুলাে জন্মাতে পারত না, জন্মালেও বাঁচতে পারত না, তার ফলে পরিবেশের ভয়াবহ একটি বিপর্যয় ঘটত।
জলজ প্রাণীর জন্য পানির প্রয়ােজনীয়তা
হাজার হাজার জলজ প্রাণীর মাঝে আমাদের সবচেয়ে পরিচিত জলজ প্রাণী হচ্ছে মাছ। মাছ ধরে পানির বাইরে রেখে দিলে কী হয়? তােমরা সবাই দেখেছ যে মাছ মরে যায়। কেন মরে যায়? কারণ আমরা যেরকম বাতাস বা অক্সিজেন ছাড়া বাঁচতে পারি না, দম বন্ধ হয়ে মারা যাই, মাছের বেলাতেও তাই ঘটে। মাছ অক্সিজেন গ্রহণ করে ফুলকা দিয়ে আর ফুলকা এমনভাবে তৈরি যে এটি শুধু পানি থেকেই অক্সিজেন নিতে পারে, বাতাস থেকে নয়।
যদি পানি না থাকত তাহলে কোনাে মাছ বাঁচতে পারত না। শুধু মাছ নয়, যেসব প্রাণী ফুলকা দিয়ে অক্সিজেন গ্রহণ করে শ্বাসকার্য চালায়, তাদের কোনােটাই বাঁচতে পারত না। ফলে পরিবেশ হুমকির মধ্যে পড়ত আর আমাদেরও বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যেত।
তােমরা আগের অধ্যায় থেকে জেনেছ যে প্রােটিন আমাদের বেড়ে ওঠার জন্য খুবই প্রয়ােজনীয় একটি উপাদান। আমাদের প্রয়ােজনীয় প্রােটিনের প্রায় শতকরা ৮০ ভাগই আসে মাছ থেকে। কাজেই পানি না থাকলে আমরা প্রয়ােজনীয় প্রােটিন পেতাম না, যার ফলে আমাদের দৈহিক বৃদ্ধি এবং অন্যান্য কোনাে জৈবিক প্রক্রিয়াই ঠিকভাবে ঘটতাে না।