সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক রচিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কাব্যনাট্য ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। ১৯৭৫ সালের ১ মে-১৩ জুন পর্যন্ত লন্ডনের হ্যাম্পস্টেডে তিনি নাটকটি রচনা করেন। নাটকটিতে আলাদা কোনাে দৃশ্য বিভাজন নেই। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নাটকটি একটানা লিখিত হয়েছে।
বিষয়বস্তুর দিক থেকে মুক্তিযুদ্ধকালীন অবস্থার প্রতিফলন হওয়াতে তঙ্কালীন বাস্তব চিত্র হিসেবে নাটকটি বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী। লেখকের বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে ঘটনা বর্ণনা ও চরিত্রচিত্রণে বিশেষ দক্ষতার প্রকাশ ঘটেছে। এ কাব্যনাট্যে উপভাষার প্রয়ােগে লেখক বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন।
এখানে উপভাষার প্রয়ােগ হয়েছে বােধগম্য ও সরল চলিতরূপে। মুখের ভাষাকে পরিশীলিত করে কাব্যভাবনার উপযুক্ত করে তােলা হয়েছে। সৈয়দ শামসুল হকের প্রথম কাব্যনাট্য হলেও পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় বিশেষ সাফল্য অর্জন করে এবং মঞ্চেও তা অত্যধিক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় নাটকের বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিককার ঘটনাবলি। নাটকের চরিত্র হিসেবে রয়েছে মাতবর, পীর সাহেব, মাতবরের মেয়ে, পাইক, গ্রামবাসী, তরুণ দল ও মুক্তিযােদ্ধারা। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তাদের। উদ্বেগ আর উকণ্ঠাকে কেন্দ্র করেই নাটকের পটভূমি তৈরি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ চলছে কালীপুর, হাজীগঞ্জ কিংবা ফুলবাড়ী, নাগেশ্বরী থেকে দলে দলে মানুষ আসছে। “মানুষ আসতে আছে যমুনার বানের লাহান/মানুষ আসতে আছে মহররমে ধুলার সমান”।
হতবিহ্বল গ্রামবাসী মুক্তিযুদ্ধকালে নিজেদের করণীয় কিংবা বাঁচার উপায় মাতবরের কাছে জানতে চায়। গ্রামবাসীর – ধারণা, মাতবর ক্ষমতার অধিকারী। তাই একমাত্র তিনিই পারেন ভয়াবহ এ বিপদ থেকে সবাইকে রক্ষা করতে। এই মাতবরই হচ্ছেন নাটকের প্রধান চরিত্র। মাতবর এক পর্যায়ে তাদের আশ্বস্ত করেন, গত রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেনের সঙ্গে তার দেখা ও আলাপ হয়ে য়ছে। তাই মাতবর সবাইকে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর ভরসা রাখতে বলেন। পাশাপাশি মুক্তিবাহিনী থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেন। তবে মাতবরের আশ্বাসের পরও গ্রামবাসীর মনের দ্বিধা দূর হয় না। মাতবর মূলত, পাকিস্তান।
সেনাবাহিনীর সহযােগী, অর্থাৎ রাজাকার। কিন্তু তিনি যে পাকিস্তানপন্থী, সেটা গ্রামের সহজ-সরল মানুষ শুরুতে আন্দাজ করতে পারে না। এমনই এক সময়ে মাতবরের মেয়ে ঘরের বাইরে এসে জানায়, তার বাবা মূলত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দোসর। জোর করে গত রাতে তাকেও মাতবর পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। মাতবর ও তার মেয়ে এবং গ্রামবাসীর একের পর এক সংলাপে মুক্তিসংগ্রামের বিষয়গুলাে পরিস্ফুটিত হতে থাকে।
মাতবর গ্রামবাসীকে জানান, তার মেয়েকে তিনি এক রাতের জন্য হলেও পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের কাছে বিয়ে দিয়েছিলেন। এক পর্যায়ে মাতবরের মেয়ে অপমানে-লজ্জায় বিষপানে আত্মহত্যা করে। ঘটনা এগােতে থাকে। গ্রামের মানুষ মাতবরের মৃত্যু চায়। এদিকে মাতবরের কানে বারবার পায়ের আওয়াজ ভেসে আসতে থাকে। এই আওয়াজ আসলে মুক্তিযােদ্ধাদের পদধ্বনি। বিশ্বাসঘাতকতার কারণে মাতবরের পাইক একসময় মাতবরকে হত্যা করে। এক রাজাকারের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি জাতীয় জীবনে মুক্তির পথ দেখতে পায়।
1 Comment
শারমিন আলম নীতি
Very helpful