১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ৫৬,৯৭৭ বর্গমাইলের বর্তমান বাংলাদেশের জন্ম হয়। ১৯৪৭-১৯৭১ পর্যন্ত বাংলাদেশের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান, ১৯৪৭’র পূর্বে ব্রিটিশ আমল বা তারও পূর্বে বর্তমান বাংলাদেশসহ আরও বিস্তৃত অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল বৃহত্তর বাংলা অঞ্চল। অর্থাৎআজকের বাংলাদেশ, অতীতে যা পূর্ব পাকিস্তান, পূর্ব বাংলা, বাংলা, বঙ্গ, গৌড় ইত্যাদি নামে পরিচিত ছিল তার একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে।
ভূ-প্রাকৃতিক গঠন বৈশিষ্ট্যের আলােকে বাংলাকে ৫টি ভাগে ভাগ করা যায়— উত্তর বাংলার পাললিক সমভূমি; ব্রহ্মপুত্রমেঘনা অন্তবর্তী ভূভাগ; ভাগীরথী—মেঘনা। অন্তর্বর্তী ব-দ্বীপ; চট্টগ্রামের অনুচ্চ পার্বত্য এলাকা এবং বর্ধমান অঞ্চলের অনুচ্চ পার্বত্য এলাকা। বাংলার ভূ-প্রকৃতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নদীর। বাংলার বিস্তীর্ণ ভূভাগ নদীবাহিত পলি দ্বারা গঠিত এবং পশ্চিম, উত্তর ও পূর্ব বাংলার কিছু অংশ ছাড়া বাংলার প্রায়। সবটাই ভূ-তত্ত্বের আলােকে নবসৃষ্ট।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশে আদিম মানব সভ্যতার যেরূপ বিবর্তন ঘটেছিল, বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। বাংলার পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তে প্রাচীন ও নব্যপ্রস্তর যুগের এবং তাম্র যুগের নিদর্শন। পাওয়া গেছে। এই সকল যুগে বাংলার পার্বত্য সীমান্ত অঞ্চলে মানুষ বসবাস করত এবং ক্রমে তারা অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে।
আরো পড়ুন : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন ও উত্তর
বৈদিক যুগে আর্যদের সঙ্গে বাংলাবাসীর কোনােরূপ সম্পর্ক ছিল না। বৈদিক গ্রন্থাদিতে বাংলার নরনারীকে অনার্য ও অসভ্য বলা হয়েছে। এ থেকেই প্রমাণ হয় বাংলার আদিম অধিবাসীরা আর্যজাতির বংশােদ্ভূত নয়। আর্যদের আগমনের পূর্বে বাংলাদেশে বিভিন্ন জাতি বসবাস করত; যথা কোল, শবর, পুলিন্দ, ডােম, চন্ডাল ইত্যাদি। এইসব জাতিকে ‘অস্ট্রিক’ মানবগােষ্ঠীর বংশধর বলে ধরা হয়।
আনুমানিক ৫,০০০-৬,০০০ বছর পূর্বে ইন্দোচীন থেকে আসাম হয়ে এ অস্ট্রিক গােষ্ঠীর বঙ্গদেশে আগমন ঘটে। এরা দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করত। তাদের সুসংগঠিত সমাজকে কোম বলা হতাে। এরা চাষাবাদ, লােহা-তামা প্রভৃতির ব্যবহার জানত। প্রাচীন এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোনাে গােষ্ঠী ক্রমেই বৃহত্তর শংকর বাঙালি জাতিগােষ্ঠীর উদ্ভব ও বিস্তার ঘটায় বাংলাদেশ ভূখন্ডে। সুতরাং বাঙালি জাতির প্রধান অংশ গড়ে উঠেছিল অস্ট্রিক বা অনার্য গােষ্ঠী থেকে।
প্রাচীন বাংলার জনপদ |
|
জনপদ | বর্তমান অঞ্চল |
গৌড় | উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল, আধুনিক মালদহ, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বর্ধমানের কিছু অংশ ও চাপাইনবাবগঞ্জ |
বঙ্গ | ফরিদপুর, বরিশাল, পটুয়াখালীর নিম্ন জলাভূমি, বৃহত্তর বগুড়া, পাবনা, ময়মনসিংহ জেলার পশ্চিমাঞ্চল, ঢাকা, কুষ্টিয়া, বৃহত্তর কুমিল্লা, নােয়াখালীর কিছু অংশ, যশাের ও নদীয়া |
পুন্ড্র | বৃহত্তর বগুড়া, রাজশাহী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার অংশবিশেষ। |
হরিকেল | চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, ত্রিপুরা ও সিলেট (শ্রীহট্ট) |
সমতট | বৃহত্তর কুমিল্লা ও নােয়াখালী অঞ্চল |
বরেন্দ্র | বগুড়া, পাবনা, রাজশাহী বিভাগের উত্তর পশ্চিমাংশ, রংপুর ও দিনাজপুরের কিছু অংশ । |
তাম্রলিপ্তি | বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর (প্রাচীন যুগে মিথুনাপুর নামে পরিচিত) জেলা |
চন্দ্রদ্বীপ | বরিশাল |
উত্তর রাঢ় | মুর্শিদাবাদ জেলার পশ্চিমাংশ, সমগ্র বীরভূম জেলা ও বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমা |
দক্ষিণ রাঢ় | বর্ধমানের দক্ষিণাংশ, হুগলির বহুলাংশ ও হাওড়া জেলা |
বাংলা বা বাঙলা | খুলনা, বরিশাল ও পটুয়াখালী |
দণ্ডভুক্তি | পশ্চিমবঙ্গের (ভারত) দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল |
বিক্রমপুর | মুন্সিগঞ্জ জেলা ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চল |
সপ্তগাঁও | খুলনা ও সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চল |
কামরূপ | রংপুর, জলপাইগুড়ি ও আসামের কামরূপ জেলা। |
আরাকান | কক্সবাজার, মিয়ানমারের কিছু অংশ ও কর্ণফুলি নদীর দক্ষিণ অঞ্চল |
সূহ্ম | গঙ্গা-ভাগীরথীর পশ্চিম তীরের দক্ষিণ ভূ-ভাগ, আধুনিক মত অনুসারে, বর্ধমানের দক্ষিণাঞ্চল, হুগলির বৃহদাংশ, হাওড়া এবং বীরভূম জেলা |
প্রাচীন বাঙালি জনগােষ্ঠীকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। প্রাক আর্য বা অনার্য নরগােষ্ঠী এবং আর্য নরগােষ্ঠী। আর্যপূর্ব জনগােষ্ঠী মূলত চার ভাগে বিভক্ত— নেগ্রিটো, অস্ট্রিক, দ্রাবিড় ও ভােটচীনীয়। অস্ট্রিক গােষ্ঠী থেকে বাঙালি জাতির প্রধান অংশ গড়ে উঠেছে বলে মনে করা হয়। অস্ট্রিক জাতিকে নিষাদ জাতিগােষ্ঠী নামেও অভিহিত করা হয়।
প্রায় পাঁচ-ছয় হাজার বছর পূর্বে অস্ট্রিক জাতি ইন্দোচীন থেকে বাংলায় প্রবেশ করে এবং নেগ্রিটোদের পরাজিত করে। সমসাময়িক সময়ে বা কিছুদিন পরে দ্রাবিড় জাতি খাইবার গিরিপথ দিয়ে বাংলায় প্রবেশ করে এবং তারা অস্ট্রিক জাতির ওপর। কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।
আরো পড়ুন : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দ্বিতীয় গ্রন্থ কারাগারের রােজনামচা
অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় জাতির সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয় আর্যপূর্ব জনগােষ্ঠী। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে বঙ্গ ভূখণ্ডে আর্যগণ আগমন করে। বাংলার আদি অধিবাসীদের ভাষা ছিল অস্ট্রিক। আর্যদের আগমনের ফলে। ধীরে ধীরে অস্ট্রিক ভাষা হারিয়ে যেতে থাকে এবং বিবর্তনের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়। কাজেই বলা যায় বাঙালি জাতি যেমন সংকর তেমনি বাংলা ভাষাও সংকর।
ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসনামলে বাংলা’ শব্দের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। সম্রাট আকবরের আমলে সমগ্র ‘বাংলা’ তথা ‘বঙ্গ’ দেশ ‘সুবাহ-ই-বাঙ্গালাহ’ নামে পরিচিত ছিল। ফারসি ‘বাঙ্গালাহ’ শব্দ থেকে পর্তুগিজ Bangle এর ইংরেজি Bengal শব্দ থেকে এর উৎপত্তি। বাংলা বা বাঙালি নামের উৎপত্তি নিয়ে একাধিক তথ্য পাওয়া যায়।
মােগল সম্রাট আকবরের সভাসদ আবুল ফজল তার ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে দেশবাচক ‘বাংলা’ শব্দ ব্যবহার করে এর উৎপত্তি সম্পর্কে। দেখিয়েছেন যে, এ দেশের প্রাচীন নাম ‘বঙ্গ’ এর। সাথে বাঁধ বা জমির সীমানা নির্ধারক আল (আল বা আইল) প্রত্যয়যােগে ‘বাংলা’ শব্দ গঠিত হয়েছে।
প্রাচীন কালে বঙ্গের রাজারা ১০ গজ উঁচু এবং ২০ গজ বিস্তৃত প্রকাণ্ড আল নির্মাণ করতেন তাই এর নাম বঙ্গের সাথে আল যােগ করে হয়েছে বাঙ্গালা। শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ বাংলার নামকরণ করেন ‘মূলক-ই-বাঙ্গালাহ’। ‘বাঙ্গালাহ’ থেকে বাংলা এবং ‘মূলক’ অর্থ দেশ। সুতরাং ‘মূক-ই-বাঙ্গালাহ’ থেকে বাংলাদেশ।
আর্যপূর্ব বাংলার লােকালয়ের বাইরে গ্রাম-দেবতার অবস্থিতি ছিল, নানা ধরনের ধ্বজা-পূজা ছিল। এ সবই কোম সমাজের পূজা। এ ছাড়া চাষাবাদের সঙ্গেও নানা ধরনের দেবদেবীর ; পূজা জড়িত ছিল। রথযাত্রা, ন্যাত্রা, দোলযাত্রা ইত্যাদি আদি যুগেরই অবদান।
প্রাক-বৈদিক যুগে কোমদের অন্যতম ধর্মোৎসব ছিল ব্রত। শিবপূজা মধুসংক্রান্তি, পৃথিপূজা ইত্যাদি; উল্লেখযােগ্য ব্রত। কোমদের দেবতা ছিলেন ধর্মঠাকুর। রাঢ়দেশেই ধর্মপূজার প্রচলন ছিল। বাংলার কৃষিজ সমাজে ভালাে ফসলের আশায় হােলি উৎসব পালন করা হতাে।
এছাড়া মনসা পূজা, জাঙ্গুলী দেবীর পূজা, পর্ণশবরী শারববাসব, ঘটলক্ষ্মী, ষষ্ঠীপূজা ইত্যাদি আর্যপূর্ব কোম সমাজের অবদান। তবে প্রাক-গুপ্ত যুগে জৈন ধর্ম, আজীবিক ই ও বৌদ্ধধর্মের বিস্তার ঘটে বাংলার সমাজে। ষষ্ঠ শতকেব্রাহ্ম বংশের প্রভাবাধীন বৈদিক ধর্মের বিস্তর প্রসার ঘটেছিল বাংলাদেশে। পাল যুগে বৌদ্ধ এবং সেন যুগে ব্রাহ্মণ ধর্মের জয়জয়কার অবস্থা বিরাজ করেছিল। এছাড়া পৌরাণিক ধর্ম, বৈষ্ণবধর্ম, শৈব ধর্ম (হিন্দু ধর্মের বিশেষ শাখা), সহজিয়া ধর্মের প্রভাবও কমবেশি বাংলায় ঘটেছিল।
প্রাচীন বাংলার শিক্ষাদীক্ষা ও জ্ঞানবিজ্ঞান সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে বেদ-ব্রাহ্মণ-উপনিষদ, ধর্মশাস্ত্র, ধর্মসূত্র, প্রাচীগ্রন্থ ইত্যাদিতে যেসব তথ্য পাওয়া যায় তাতে প্রাচীন বাংলার কথা তেমন উল্লেখ নেই। তারপরও সুদূর প্রাচীনকালে এ দেশে গৃহবদ্ধ, পরিবারবদ্ধ ও সমাজবদ্ধ। মানুষের মধ্যে শিক্ষাদীক্ষার একটা সংস্কার ছিল। কিন্তু তাতে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা ছিল না। শিক্ষা ও জ্ঞান চর্চায় আমাদের।
আরো পড়ুন : সেপ্টেম্বর মাসের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসসমূহ
প্রাতিষ্ঠানিক সম্পৃক্ততার কিছুটা প্রমাণ পাওয়া যায় মৌর্য আমল (খ্রি. পূ. তৃতীয় শতক) থেকে। তবে বৌদ্ধ সংঘরাম এবং ব্রাহ্মণ্য ধর্মকেন্দ্রগুলােই প্রথম ছােট বড় শিক্ষায়তন। হিসেবে এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নালন্দার। মহাবিহারের মাধ্যমে ৬ষ্ঠ-৭ম শতকীয় জ্ঞানবিজ্ঞান ও শিক্ষাদীক্ষার সঙ্গে বাংলার ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ গড়ে উঠে।
পালযুগে বাংলায় জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার উৎসাহ পরিলক্ষিত হয়; ঐ সময় চতুস্পাঠী শিক্ষা গড়ে তােলা হয়। বিদ্যার্থীরা বাংলার বাইরেও লেখাপড়া করতে যেতেন। গ্রন্থরচনা, চিকিৎসাশাস্ত্র, ব্যাকরণ ও অভিধান চর্চা, ধর্মচর্চা ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রাচীন বাংলায় আমাদের কিছুটা সাফল্য ছিল।
Leave a Comment