বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবিদের একজন শামসুর রাহমান। তিনি গল্প, উপন্যাস, সমালােচনা, প্রবন্ধ ও কলাম রচনা করলেও কবি হিসেবেই ছিলেন সুপরিচিত এবং পাঠকনন্দিত। একজন স্বনামধন্য সাংবাদিক হিসেবেও তাঁর খ্যাতি রয়েছে। বাংলাদেশে প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তমনা সমাজ গঠনে তাঁর ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
‘বন্দী শিবির থেকে তাঁর বহুল আলােচিত একটি কাব্যগ্রন্থ। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়। এটি প্রকাশ করেছিল কলকাতার অরুণা প্রকাশনী এবং প্রচ্ছদ করেছেন পূর্ণেন্দু পত্রী। উৎসর্গ ছিল না। এ বইয়ে ১৪টি কবিতা সংকলিত হয়েছে। ‘বন্দী শিবির থেকে বইয়ের প্রথম বাংলাদেশ সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালের এপ্রিল মাসে।
বাংলাদেশ সংস্করণের প্রকাশক ছিল চট্টগ্রামের বইঘর, বিপণিবিতান। এ বইয়ের অধিকাংশ কবিতা রচিত হয়েছে ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর মাসে। তবে বাংলাদেশ সংস্করণে আগের ১৪টি কবিতার সঙ্গে আরও ২৪টি কবিতা যুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশ সংস্করণটি উৎসর্গপত্রে এভাবেই লেখা আছে, গুলিবিদ্ধ একাত্তরে যাদের প্রবল রক্তসেচে/ জনসাধারণ দীপ্র ফসলের মতাে আছে বেঁচে।
এই বিভাগ থেকে আরো পড়ুন
- ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ : সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্
- পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় : সৈয়দ শামসুল হক
- লালসালু উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু
- চিলেকোঠার সেপাই সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য
- ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস
প্রথমা থেকে প্রকাশিত শামসুর রাহমানের প্রথম গান থেকে বন্দী শিবির’ (অক্টোবর ২০১৩) বইয়ের প্রথম ফ্ল্যাপে লেখা আছে, ‘শামসুর রাহমান তাঁর জীবদ্দশায়ই বাংলাদেশের কবিতার প্রধান পুরুষ হিসেবে স্বীকৃত হন। এ দেশের বাঙালির কাব্যরুচি তৈরি হয় তাঁর কবিতার মধ্য দিয়ে। প্রায় পাঁচ যুগের নিরবচ্ছিন্ন কবিতাচর্চার ফল তার বিপুল কবিতাসম্ভার।
কাব্যগ্রন্থের মূলভাব
শামসুর রাহমানের ‘বন্দী শিবির থেকে গ্রন্থে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চেতনাগত ইতিহাস পরিস্ফুট হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালি জাতীয়তাই হচ্ছে এ বইয়ে সংকলিত কবিতার মূল বিষয়বস্তু। কবিতার পরতে পরতে আছে। অসাম্প্রদায়িক চেতনা আর জাতীয়তাবাদের উজ্জ্বল সব পক্তি। ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাম্যতার জয়গান আছে। কবিতাজুড়ে।
মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যেহেতু শামসুর রাহমান ‘বন্দী শিবির থেকে কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলাে রচনা করেছেন, তাই প্রায় কবিতায় বাঙালির আকাঙ্ক্ষা ও মুক্তির প্রসঙ্গগুলােও উপস্থাপিত হয়েছে। তার দেখা তৎকালীন সমাজবাস্তবতা ও বাঙালির চেতনাগত বিষয়গুলাে কবিতার পঙ্ক্তিতেই শামসুর রাহমান ঠাই দিয়েছেন।
উপমা আর চিত্রকল্পের অনন্যতায় গ্রন্থভুক্ত প্রতিটি কবিতাই বিশিষ্টতা অর্জন করে নিয়েছে। শামসুর রাহমানের অতি বিখ্যাত ‘তােমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতা তুমি’ কবিতা দুটিও ‘বন্দী শিবির থেকে বইয়ে সংকলিত হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক অমর সাহিত্যের প্রসঙ্গ এলেই আলােচনায় এ দুটি কবিতা থাকে সবার সামনে।
এ দুটি কবিতার প্রায় সব কটি পঙ্ক্তিই মানুষের মুখে মুখে ফেরে সকিনা বিবি আর হরিদাসীর যন্ত্রণাদগ্ধ হৃদয়ের ব্যথা কিংবা যে শিশুটি মা-বাবার লাশের ওপর হামাগুড়ি দিয়েছিল, তাদের করুণ কাহিনি শামসুর রাহমান লিখেছেন তাঁর কবিতায়। স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য মানুষের ভেতরে যে আকাঙ্ক্ষা ছিল, তা-ও তাঁর কবিতায় এসেছে সবিস্তার।
‘বন্দী শিবির থেকে’ বইয়ে সংকলিত শামসুর রাহমানের কবিতাগুলাে উজ্জীবিত করে, আশার বাণী শােনায়। ‘গেরিলা’ কবিতায় শামসুর রাহমান শেষ দুটি পঙ্ক্তি এভাবেই লিখেছেন, ‘সর্বত্র তােমার পদধ্বনি শুনি, দুঃখ-তাড়ানিয়া;/তুমি তাে আমার ভাই, হে নতুন, সন্তান। আমার। এ দুটি পঙ্ক্তিতেই কবি তাঁর দর্শন চিনিয়েছেন, নিশ্চয়ই কবির এ আশার আলাে ছড়িয়ে যাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, আর এখানেই শামসুর রাহমান অন্য সাহিত্যিকদের চেয়ে আলাদা, অনন্যও।
প্রশ্ন-উত্তর
প্রশ্ন : শামসুর রাহমানের জন্ম কবে ও কোথায়?
উত্তর : ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর, ঢাকার মাহুতটুলীতে। তবে তাঁর পৈতৃক ভিটা নরসিংদী জেলার রায়পুরায়, পাড়াতলী গ্রামে।
প্রশ্ন : শামসুর রাহমানের প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ কোনটি?
উত্তর : ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ (১৯৬০)।
প্রশ্ন : শামসুর রাহমানের পড়াশােনা ও চাকরিজীবন সম্পর্কে বলুন।
উত্তর : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক (১৯৫৩)। পেশা ছিল সাংবাদিকতা, দৈনিক বাংলার সম্পাদক ছিলেন।
প্রশ্ন : শামসুর রাহমান কী কী পুরস্কার পেয়েছিলেন?
উত্তর : স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, আদমজী পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার উল্লেখযােগ্য।
প্রশ্ন : শামসুর রাহমানের উল্লেখযােগ্য কয়েকটি গ্রন্থের নাম লিখুন।
উত্তর : ‘রৌদ্র করােটিতে’ (১৯৬৩), ‘বিধ্বস্ত নীলিমা (১৯৬৭), ‘নিরালােকে দিব্যরথ (১৯৬৮), ‘নিজবাসভূমে’ (১৯৭০), ‘দুঃসময়ের মুখােমুখি (১৯৭৩), উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ (১৯৮২), ‘স্মৃতির শহর’ (১৯৭৯) উল্লেখযােগ্য।
প্রশ্ন : শামসুর রাহমানের মৃত্যু হয় কবে?
উত্তর : ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট।