বাংলাদেশ একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। ভৌগােলিক অবস্থান ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশটিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিমাণ দিনদিন বেড়েই চলেছে। এসব দুর্যোগের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে কৃষি ক্ষেত্রে। ফলে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। এদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি কৃষি। এদেশের প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। উৎপাদনশীলতা ও আয় বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বিশাল জনগােষ্ঠীর সমৃদ্ধির জন্য কৃষির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। দেশের জিডিপিতে কৃষি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। প্রধান কৃষি কাঁচামাল কৃষিভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করে। কৃষি সামাজিক কর্মকাণ্ডের এক বিশেষ ক্ষেত্র যা জনগণের খাদ্য ও পুষ্টির নিশ্চয়তা, আয়ের সুযােগ সৃষ্টি এবং দারিদ্র্য হ্রাসকরণের মতাে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলাের সাথে ওতােপ্রােতভাবে জড়িত। এছাড়াও কৃষি বিভিন্ন ধরনের ভােগ্যপণ্যের বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় ভােক্তাদের চাহিদাভিত্তিক মালামালের উৎস।
প্রকৃতি যখন কোনাে বিপদ বা দুর্যোগ সৃষ্টি করে তখন তাকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এমন দুর্ঘটনা বা বিপর্যয়, যা প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে ঘটে এবং যার পিছনে মানুষের প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকে না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর প্রতিকূল প্রভাব ফেলে। প্রায় প্রতি বছরই বাংলাদেশ বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়। দেশের প্রধান প্রধান প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে রয়েছে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলােচ্ছ্বাস, খরা, নদীভাঙন, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি ও লবণাক্ততা ইত্যাদি।
বন্যা বাংলাদেশে অতি স্বাভাবিক ঘটনা। প্রতি বছর দেশের মােট আয়তনের ন্যূনতম ৫০ ভাগ এলাকা বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়। আমাদের দেশে সাধারণত বৈশাখ থেকে আশ্বিন মাসের মধ্যবর্তী সময়ে বন্যা দেখা দেয়। বাংলাদেশে ফসল উৎপাদনে সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে বন্যা। এতে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়। প্রতি বছরই বন্যার ফলে হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়ে যায়। কোনাে কোনাে এলাকায় আগাম বন্যার ফলে সময়মতাে জমি চাষ ও ফসলের বীজ বপন বা চারা রােপণও ব্যাহত হয়। বন্যায় ফসল, কষি উপকরণ, গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি, মৎস্য ও অন্যান্য কৃষি সম্পদ, জমি ও মাটির ব্যাপক ক্ষতি হয়। প্রতিবছর বন্যায় কেবল খাদ্যশস্যের বেলাতেই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১০-২৫ লক্ষ টন। অনেক অসুবিধা সৃষ্টি করলেও পরিমিত পরিমাণ বন্যা আমাদের দেশের জন্য উপকারী, কারণ বন্যার পানি প্রচুর পরিমাণ পলি বয়ে আনে, যার ফলে ফসলি জমি খুবই উর্বর হয়ে উঠে এবং পলি মিশ্রিত মাটিতে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছরই ঘূর্ণিঝড় হয়ে থাকে। প্রতি বছর উপকূলের প্রায় ২.৮৫ মিলিয়ন হেক্টর এলাকা ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছাসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জলােচ্ছ্বাসের কারণে লবণাক্ত পানি ফসলি জমিতে ঢুকে পড়ায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। বাংলাদেশে প্রধানত বৈশাখ (মধ্য এপ্রিল) থেকে আরম্ভ করে আশ্বিন-কার্তিক (নভেম্বর) মাসে ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছ্বাস হয়। জলােচ্ছ্বাসের ফলে সাধারণত ৬-১২ ঘণ্টা পর্যন্ত সমুদ্র বা নদীর অতিরিক্ত পানি জমির ওপরে থাকে। তবে পানি সরে যাওয়ার পরও এর প্রভাব থেকে যায় অনেকদিন পর্যন্ত। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলবর্তী ১৩টি জেলার প্রায় একশ থানা জলােচ্ছাসের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। জলােচ্ছ্বাসের ফলে ফসল ও অন্যান্য সম্পদ বিনষ্ট হয় বা ভেসে যায়, মাটিতে লােনা ধরে এবং জলাবদ্ধতার ফলে জমির ফসল ও গাছপালা মারা যায়।
খরা বাংলাদেশের একটি অতি পরিচিত ও মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। খরার কারণে এদেশে ৩০-৭০% পর্যন্ত ফসলহানি হয়ে থাকে। গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য মাটিতে প্রয়ােজনীয় পানির ঘাটতি হলে সেই অবস্থাকে খরা বলা হয়। খরা বাংলাদেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রাকবর্ষা এবং বর্ষাকাল পরবর্তী সময়ের ফসলকে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশে মার্চ-এপ্রিল মাসের খরার কারণে আমন, আউশ ও পাট চা উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের খরা আমন ও রােপা ধানের উৎপাদনকে ব্যাহত করে এবং ডাল ও আলু ফসলের চাষকে বিলম্বিত করে। বরেন্দ্র অঞ্চল ও গঙ্গা পলিমাটি এলাকার নওয়াবগঞ্জ, রাজশাহী ও নওগাঁ জেলায় প্রায় ১০ লক্ষ হেক্টর জমিতে প্রতি বছর প্রচণ্ড খরা দেখা দেয়। এছাড়াও সারাদেশে প্রায় ৫০ লক্ষ হেক্টর জমিতে মাঝারি ধরনের খরা দেখা দেয়। গম, মসুর, সরিষা, গােল আলু, ধান, আখ, ফলমূল ও শাকসবজিসহ প্রায় সকল ধরনের ফসলেই খরায় গড়ে ৩০% ফলন কম হয়। খরা ফসলি জমি ও পরিবেশের ওপর বিভিন্নভাবে প্রভাব বিস্তার করে। খরায় গাছে ফুল-ফল ঝরে পড়ে এবং চারা গাছ মারা যায়। ফসলের বৃদ্ধি কমে যায়, জমি প্রস্তুতিতে অসুবিধা হয়। বীজ বােনা যায় না ও জমিতে লবণাক্ততা বেড়ে যায়।
বৃষ্টিপাত ফসল উৎপাদনের অন্যতম নিয়ামক। প্রতিটি ফসলের বৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ পানির প্রয়ােজন হয়। অপর্যাপ্ত এবং অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত উভয়ই ফসলের উৎপাদনকে ব্যাহত করে। বাংলাদেশে আমন ধানের দৈহিক বৃদ্ধি ও প্রজনন পর্যায়ে এবং ফসল পরিপকৃতার সময় বৃষ্টিপাত কম বেশির কারণে ধানের উৎপাদন হ্রাস-বৃদ্ধি পায়। শীতকালে বৃষ্টিপাতের ফলে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এবং ২০৩০ সালে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১০-১৫% এবং ২০৭৫ সালে প্রায় ২৭% বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে – শীতকালের ব্যাপ্তি ও শীতের তীব্রতা দুই-ই কমে আসছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ধান গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয় ” এবং ফলন কমে যায়। ধান গাছের ফুল ফোটার সময় তাপমাত্রা ৫° সেলসিয়াস বা তার বেশি এবং ২০° সেলসিয়াসের নিচে থাকলে শিষে ধানের সংখ্যা কমে যেতে পারে। পরাগায়নের সময় অতি উষ্ণ তাপমাত্রা থাকলে চিটার সংখ্যা বেশি হয়। অতিরিক্ত তাপ ও আর্দ্রতা গাছে ছত্রাকের সংক্রমণ ঘটায়। উচ্চ তাপমাত্রায় গাছের পাতার পরিপক্বতা। দ্রুত হয়, বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং ফল ও পাতা বিবর্ণ হয়। এছাড়া উচ্চ তাপমাত্রা অনেক বীজের অঙ্কুরােদ্গমকে হ্রাস করে। হঠাৎ তীব্র শৈত্যপ্রবাহ হলে সরিষা, মসুর, ছােলা ইত্যাদি ফসলের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। এসব ফসলের পরাগায়ন ব্যাহত হয়ে ফলন কমে যায়। শৈত্যপ্রবাহের সঙ্গে দীর্ঘসময় কুয়াশাচ্ছন্ন থাকলে অনেক ফসল বিশেষ করে গমের পরাগায়ন ও গর্ভধারণ না হওয়ায় আংশিক বা সম্পূর্ণ ফসল চিটা হয়ে যায়। পােকামাকড়ের উপদ্রব বেড়ে যায়। শৈত্যপ্রবাহের ফলে আমের মুকুল নষ্ট হয়, ও নারকেলের ফলধারণ ব্যাহত হয়।
মাটির লবণাক্ততা কৃষিজ ফসলের জন্য একটি বড় হুমকি। মাটিতে লবণাক্ততার আধিক্যের কারণে এদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হয়। লবণাক্ততা সহনশীল ফসলসমূহে মাটির অত্যধিক লবণাক্ততায় বীজের অঙ্কুরােদগম ও বৃদ্ধিহাস পায়। পাতার অকাল পরিপক্বতা আনয়ন বাশাখা প্রশাখার সংখ্যাহাস এবং সর্বোপরি সালােকসংশ্লেষণকে হ্রাস করে ফসলের ফলনকে। ব্যাহত করে। মাটিতে লবণের আধিক্য ফসলকে মাটি থেকে পানি ও পুষ্টি উপাদান শােষণ বাধাগ্রস্ত করে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা ফসল চাষে একটি বড় সমস্যা। এ অঞ্চলে বর্ষাকালে বৃষ্টিতে লবণের মাত্রা কমে গেলেও শুষ্ক মৌসুমে বাষ্পীভবনের মাধ্যমে পানির সাথে লবণ উঠে আসায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশের মােট উপকলীয় এলাকার প্রায় ১০.৫০ লাখ হেক্টর জমি বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততায় আক্রান্ত। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে সম্ভাব্য প্রতিরােধের ব্যবস্থা নেওয়া না হলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলােয় লবণাক্ততার কারণে জমি চাষের উপযুক্ততা হারাবে এবং স্বাভাবিক ফসল। ফলানাে অসম্ভব হয়ে পড়বে।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং ফসল উৎপাদনের ওপর এর বিরূপ প্রভাব সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের অনেক দেশে একটি প্রধান সমস্যা। এর ফলশ্রুতিতে ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ২০৮০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের উপকূলে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা ৬৬ সে.মি. বৃদ্ধি পেলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ফসলি জমি হারিয়ে যাবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট লবণাক্ততা ও বন্যা বা জলােচ্ছ্বাস ফসলহানি, চাষযােগ্য জমি হ্রাস এবং ভূমিক্ষয়ের মতাে সমস্যা সৃষ্টি করবে, যার বিরূপ প্রভাব পড়বে দেশের ফসল উৎপাদন ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে।
বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের আধিক্য ফসলের ক্ষতি করে। কার্বন ডাই অক্সাইড সালােক সংশ্লেষণের হার বাড়িয়ে ফসলের ফলন বৃদ্ধি করে এবং শ্বসন হ্রাস করে ফসলের পরিমাণ কমায়। এছাড়াও কার্বন ডাই অক্সাইডের আধিক্য ধান, গম ইত্যাদি খাদ্যশস্যসমূহে আমিষ, মাইক্রোপুষ্টি উপাদান ও ভিটামিন বি হ্রাস করে। পুষ্টিগুণ কমিয়ে দেয়। বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের। পরিমাণ বৃদ্ধি তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, জলবায়ুর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে যা ফসলের উৎপাদনের অন্তরায়।
নদীমাতৃক বাংলাদেশের বুকে ছােট বড় বহুনদীপ্রবহমান। নদীর ধর্মই হলাে, এক কূল ভাঙা আর অন্য কূল গড়া। তাই নদী ভাঙন এদেশের একটি নিয়মিত মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রতিবছর বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে পানির প্রবল স্রোতে নদীর পাড়গুলাে বেশি ভাঙে। নদীভাঙনের ফলে প্রতি বছরই প্রচুর উৎপাদনশীল জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়। কৃষি জমি কমে উৎপাদন ব্যাহত হয়। ১৯৯৫-২০০০ সাল পর্যন্ত সারাদেশে প্রায় ৬,০০০ হেক্টর জমি নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। পাহাড়ি এলাকায় অতিবর্ষণের সময় উঁচু এলাকার উপরিভাগের উর্বর মাটি ধুয়ে ক্ষয়ে যায়, কখনাে কখনাে ভূমি ধস হয়। ফলে এসব এলাকার মাটি ক্রমান্বয়ে উর্বরতা শক্তি হারিয়ে ধীরে ধীরে ফসল উৎপাদনের অনুপযােগী হয়ে পড়ছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশের কৃষিতে অপূরণীয় ক্ষতি হয়। প্রয়ােজনীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা, দুর্যোগকালীন ফসল ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত উদ্যোগ এবং দুর্যোগ পরবর্তী পুনর্বাসন কার্যক্রম গতিশীল ও সু-সমন্বিত করে বাংলাদেশের কৃষিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত ক্ষয়ক্ষতির মােকাবিলা করা যেতে পারে।
Leave a Comment