ভারত ছাড় (Quit India) আন্দোলন
ভারতের রাজনৈতিক সংকট নিরসনে ক্রিপস মিশন ব্যর্থ হলে ১৯৪২ সালের আগস্ট মাসে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ‘ভারত ছাড়’ দাবিতে ইংরেজ-বিরােধী আন্দোলন শুরু হয়। ব্রিটিশ সরকার দমননীতি অবলম্বন করে অনেক কংগ্রেস নেতা ও কর্মীকে বন্দী করে। ফলে উপমহাদেশে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ব্যাপক আকার ধারণ করে।
মন্ত্রী মিশন ১৯৪৬
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান হলে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী এটলী ১৯৪৬ সালে ভারতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের নির্দেশ দেন। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগ অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করে। নির্বাচনের পর ভারতের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক সংকট নিরসনের জন্য প্রধানমন্ত্রী তাঁর মন্ত্রিসভার তিন জন সদস্যকে ভারতে প্রেরণ করেন। এ তিন জন মন্ত্রীবিশিষ্ট প্রতিনিধিদল মন্ত্রী মিশন নামে অভিহিত। এ সময়ে কংগ্রেস অখণ্ড ভারত নীতিতে অটল থাকে, আর মুসলিম লীগ পাকিস্তান দাবির ব্যাপারে কোনাে রকম আপােস করতে সম্মত হয়নি।
মন্ত্রী মিশনকে পাকিস্তান দাবির যৌক্তিকতা বােঝানাের জন্য ১৯৪৬ সালের এপ্রিল মাসে জিন্নাহ দিল্লীতে মুসলিম লীগের নির্বাচিত সদস্যদের এক সম্মেলন আহবান করেন। সেখানে ভাবী পাকিস্তানের রূপরেখা নিয়ে আলােচনা হয় এবং সদস্যরা পাকিস্তান অর্জনের জন্য তাদের দৃঢ় সংকল্প ঘােষণা করেন।
বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবগুলাে পেশ করেন। এ দিল্লী সম্মেলনেই লাহাের প্রস্তাবের রাষ্ট্রসমূহের স্থলে রাষ্ট্র ব্যবহার করা হয়। মন্ত্রী মিশনকে দৃঢ়ভাবে জানানাে হয়, মুসলিম লীগই ভারতের দশ কোটি মুসলমানের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান। তাদের দাবি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা। এছাড়া ভারতের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের আর কোনাে পথ নেই।
মন্ত্রী মিশন মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের সাথে আলাদা আলাদাভাবে এবং সম্মিলিতভাবে আলাপ আলােচনা করে। কিন্তু কোনাে মতৈক্যে পৌছতে পারেনি। ফলে তাঁরা ১৯৪৬ সালের ১৬ই মে তাঁদের নিজস্ব প্রস্তাব ঘােষণা করে।
মন্ত্রী মিশন প্রস্তাব করে যে, ব্রিটিশ ভারত ও দেশীয় রাজ্যগুলাে নিয়ে সর্বভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হবে। ফেডারেল সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকবে পররাষ্ট্র, দেশরক্ষা এবং যােগাযােগ ব্যবস্থা। অন্যান্য বিষয় প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকবে। ব্রিটিশ ভারতের প্রদেশগুলাে তিনটি গ্রুপে বিভক্ত থাকবে।
- হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ যুক্ত প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, বিহার, উড়িষ্যা, মুম্বাই (বােম্বাই) ও চেন্নাই (মাদ্রাজ);
- মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু প্রদেশ ও বেলুচিস্তান;
- বাংলা ও আসাম
তারা নিজ নিজ গ্রুপের সংবিধান রচনা করবে। আইনসভার প্রথম নির্বাচনের পর প্রত্যেক প্রদেশের ফেডারেল ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসার অধিকার থাকবে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিগণকে নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার গঠন করার সুপারিশ করা হয়।
মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাবগুলােতে স্বাধীন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কথা পরােক্ষভাবে নিহিত ছিল। ফলে মুসলিম লীগ মন্ত্রী মিশন পরিকল্পনা প্রস্তাব গ্রহণ করে। কংগ্রেস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যােগদান করতে অসম্মতি জানায়। কিন্তু সংবিধান রচনায় অংশগ্রহণ করতে সম্মত হয়। মুসলিম লীগ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের জন্য লর্ড ওয়াভেলকে চাপ দিতে থাকে। কিন্তু কংগ্রেসের অসহযােগিতার জন্য তিনি তাতে অসম্মত হন। এ চুক্তি ভঙ্গের জন্য মুসলিম লীগের সভাপতি জিন্নাহ মন্ত্রী মিশন পরিকল্পনা বাতিল করেন।
মুসলিম লীগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ পালনের ঘােষণা দেওয়া। হয়। ঐ দিন কলকাতায় ভীষণ দাঙ্গা-হাঙ্গামা আরম্ভ হয়। এ দাঙ্গায় হাজার হাজার নিরীহ মানুষ হতাহত হয়। এ হাঙ্গামায় মুসলমানেরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ হাঙ্গামার প্রতিক্রিয়া কয়েক দিনের মধ্যে নােয়াখালি, বিহার, মুম্বাই (বােম্বাই), পাঞ্জাব প্রভৃতি স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এ দাঙ্গার ফলে দেশ বিভাগ ত্বরান্বিত হয়।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন
মুসলিম লীগের প্রতিবাদ সত্ত্বেও ১৯৪৬ সালের ২৪শে জুন লর্ড ওয়াভেল মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাব অনুসারে জওহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করেন। ১৯৪৬ সালের ২৪শে অক্টোবর অনেক চিন্তাভাবনার পর মুসলিম লীগ অন্তর্বর্তী সরকারে যােগদান করে। কিন্তু হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি ভেঙে পড়ায় কোয়ালিশন সরকার কার্যকর হতে পারেনি। ফলে মন্ত্রী মিশন পরিকল্পনাও ব্যর্থ হয়ে যায়।
ভারত বিভাগ ও স্বাধীনতা
১৯৪৬ সালের দাঙ্গায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সমঝােতা আর সত্ব নয়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক অবস্থার অবনতি এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির জটিলতা দেখে মি: এটলী ১৯৪৮ সালের জুলাই মাসের মধ্যে ভারতীয়দের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন বলে ঘােষণা করেন। এ ঘােষণা কার্যকর করার জন্য লর্ড ওয়াভেলের থলে লর্ড মাউন্টব্যাটেন কংগ্রেস ও লীগের সাথে আলােচনা করে বুঝতে পারেন ভারত বিভাগ ছাড়া গত্যন্তর নেই।
কংগ্রেস ও লীগ নিজ নিজ দাবিতে অটল থাকে। শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস ও লীগের দাবি অনুসারে ভারত বিভাগে রাজি হন। তবে তাদের শর্ত মতাে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অনুযায়ী বাংলা ও পাঞ্জাবকে ভাগ করতে হবে। জিন্নাহ এ প্রস্তাবে রাজি হলে মাউন্টব্যাটেন ভারত বিভাগের সুপারিশ করেন।
১৯৪৭ সালের ৩রা জুন লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারত বিভাগের নীতি ঘােষণা করেন। ১৯৪৭ সালের ১৮ই জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভারত স্বাধীনতা আইন পাস করে। ১৪ই আগস্ট করাচিতে পাকিস্তানের হাতে এবং ১৫ই আগস্ট দিল্লীতে ভারতের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়। এভাবে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুইটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র পৃথিবীর বুকে জন্মলাভ করে।