100 English Essay For Juniors

পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক সত্তাকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টা চালায়, যার প্রেক্ষিতে সূচিত হয় ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্যসাধারণ ঘটনা। ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে।

ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায় :

১৯৪৭ সালের ২রা সেপ্টেম্বর তমদুন মজলিস’ নামে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। এ প্রতিষ্ঠানটি বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম ও আইন-আদালতের ভাষা হিসেবে ব্যবহার করার জন্য জোর প্রচারণা চালায়। তমদুন মত জলিসের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে সর্বপ্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে করাচিতে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে শিক্ষা সম্মেলনে সর্বসম্মক্ৰিমে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ৬ই ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম করার দাবি জানিয়ে প্রস্তাব গৃহীত হয়।

ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় :

১৯৪৮ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এ অধিবেশনে বাংলাকে অন্যান্য ভাষার সাথে অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহার করার দাবি উত্থাপন করা হয়। প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। লিয়াকত আলী খান, নাজিমউদ্দীন প্রমুখ মুসলিম লীগ নেতা তার প্রস্তাবটির বিরােধিতা করেন। ফলে ১৯৪৮ সালে ২৬শে ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করে বাংলা ভাষার সমর্থনে শ্লোগান দিতে থাকে।

ভাষা আন্দোলন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ১৯৪৮ সালে ২রা মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ নামে এক সর্বদলীয় পরিষদ গঠিত হয়। এ পরিষদ বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য একটি প্রস্তাব করে। সরকারি ভাষার তালিকা থেকে বাংলা ভাষাকে বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে ১৯৪৮ সালে ১১ই মার্চ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান জানায়। দেশের সর্বত্র ধর্মঘট পালিত হয়। পুলিশ বিভিন্ন জায়গায় লাঠিচার্জ করে। ফলে অনেকেই আহত এবং গ্রেপ্তার হয়।

১১ই মার্চের পুলিশের জুলুমের প্রতিবাদে ও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৩ই মার্চ হতে ১৫ই মার্চ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। দেশের সকল জেলাতেও পূর্ণ ধর্মঘট পালিত হয়। ১৫ই মার্চে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীনের সঙ্গে সংগ্রাম পরিষদের পরপর দুইটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনেক তর্ক-বিতর্কের পর নাজিমউদ্দীন ও সংগ্রাম পরিষদের মধ্যে ৭ দফাবিশিষ্ট এক চুক্তি সম্পাদিত হয়।

চুক্তিগুলাে নিম্নে দেওয়া হল :

১। ২৯শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত বাংলা ভাষার প্রশ্নে গ্রেপ্তারকৃত সকলকে অবিলম্বে মুক্তি দান করা হবে।
২। পুলিশি অত্যাচারের বিষয়ে তদন্ত করে একটি বিবৃতি প্রদান করা হবে।
৩। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করবার জন্য পরিষদে একটি বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে।
৪। পূর্ব বাংলায় সরকারি ভাষা হিসেবে ইংরেজি উঠে যাওয়ার পর বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে প্রবর্তন করতে হবে।
৫। সংবাদপত্রের ওপর হতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে।
৬। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না।
৭। ২৯শে ফেব্রুয়ারি হতে জারিকৃত ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করা হবে।

১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে এবং ২৪শে মার্চ কার্জন হলে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মুহম্মদ আলী জিন্নাহ দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘােষণা করেন, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। তখন থেকেই ছাত্রসমাজ প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে এবং ‘না, না’ বলে তার উক্তির প্রতিবাদ জানায়।

ভাষা আন্দোলনের শেষ পর্যায় :

১৯৫০ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঘােষণা করেন, “উর্দুই। পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হবে’। ১৯৫২ সালের ২৬শে জানুয়ারি খাজা নাজিমউদ্দীনও এক জনসভায় ঘােষণা করেন, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী মহলে দারুণ হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।

সংগ্রাম পরিষদ ৩০শে জানুয়ারি প্রতীক ধর্মঘট ও সভা আহবান, ৩১শে জানুয়ারি একটি সর্বদলীয় সভা আহবান করে এবং খাজা সাহেবের বিরুদ্ধে নিন্দা ও প্রতিবাদ করে। ৪ঠা ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ একটি সভায় ২১শে ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী এক সাধারণ ধর্মঘটের এবং ঐ দিন ভাষা দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ভাষার দাবি সুপ্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প ঘােষণা করে। এ সময়ে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও ছাত্রনেতা মহিউদ্দিন আহমেদ রাজবন্দীর মুক্তি ও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আমরণ অনশন শুরু করলে আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। অবস্থা অনুধাবন করে ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ২০শে ফেব্রুয়ারি থেকে ৩০ দিনের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে মিছিল ও গণজমায়েত নিষিদ্ধ ঘােষণা করে। এতে উত্তেজনা তীব্রতর হয়।

সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের অধিকাংশ সদস্যের মতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২১শে ফেব্রুয়ারির সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্র-ছাত্রী সমবেত হয়। অধিকাংশের সম্মতিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার সাথে সাথে ছাত্র-ছাত্রীরা উত্তেজিত হয়ে ১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে’, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ইত্যাদি শ্লোগান দিতে থাকে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী প্রথম দলটি গেট থেকে রাস্তায় বের হয়। ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলে ছাত্র ও পুলিশের মধ্যে ইটপাটকেল বিনিময় হতে থাকে। পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে এবং ছাত্রদের গ্রেপ্তার করে। বেলা ১২টার দিকে পুলিশের মােটা রশির বাধা পার হয়ে উত্তেজিত ছাত্ররা দলে দলে মেডিকেল কলেজ ও হােস্টেলের দিকে যেতে থাকলে ছাত্র ও পুলিশের মধ্যে পুনরায় ইটপাটকেল বিনিময় শুরু হয় এবং এক পর্যায়ে পুলিশ ছাত্রদের ওপর কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে।

এভাবে ছাত্ৰপুলিশ সংঘর্ষ চলাকালে বেলা ৩ টার দিকে পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। এ সময় উচ্চপদস্থ পুলিশ ও সরকারি আমলারাও উপস্থিত ছিলেন। তারা ছাত্রদের প্রাদেশিক আইন পরিষদের দিকে যেতে নিষেধ করলে ছাত্ররা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। পুলিশ প্রথমে কয়েক রাউন্ড গুলি ছােড়ে এবং সে গুলিতে বরকত, রফিক, সালাম, জব্বার, শফিউর এবং আরাে অনেকে শহীদ হন এবং অনেকে হন আহত। এতে সারা পূর্ব বাংলায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ২২শে ফেব্রুয়ারি থেকে ২৭শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্মঘট পালিত হয়। ছাত্র-জনতা শহীদদের স্মৃতি অমর করে রাখার জন্য মেডিকেল কলেজের সামনে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করে। এ মিনারটি উন্মােচন করা হয় শহীদ শফিউর রহমানের পিতাকে দিয়ে।

ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য :

১৯৪৮-১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালিদের মনে স্বাধীনতাবােধ জাগ্রত হয়েছিল। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর পুরাে পঞ্চাশের দশক ছিল পূর্ব পাকিস্তানের সংগ্রামের ও চেতনার কাল, আর আইয়ুব খানের দশক ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার প্রস্তুতিকাল।। ভাষা আন্দোলন পরবর্তী সকল রাজনৈতিক আন্দোলনে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। এ আন্দোলন এদেশের মানুষকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তােলে। এ আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানিদেরকে ঐক্য ও স্বাধীনতার চেতনা দিয়েছে। একুশের চেতনা আমাদেরকে আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে স্বাধীনতা সংগ্রামে অপরিমেয় ইন্ধন যুগিয়েছে। এটি ছিল বাঙালিদের মুক্তির প্রথম আন্দোলন। একুশের চেতনা সকল স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। ভাষা আন্দোলন ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, কৃষক, শ্রমিক সকল শ্রেণীর মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিল, যার পরিণতিতে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হয়।

Related Post

Leave a Comment