মৌর্য সাম্রাজ্য ভারতের ইতিহাসে প্রথম সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য। আদি কৌম সমাজ রূপান্তরিত হয় এ মৌর্য সাম্রাজ্যে। মৌর্য সম্রাটরা বহু বিভক্ত ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করে এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। রাজ্য বিজয়, সুশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে মৌর্য সম্রাটগণ অতুলনীয় সাফল্যের পরিচয় দেন।
মৌর্যবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। পিতার মৃত্যুর পর শিশু চন্দ্রগুপ্ত মাতার সঙ্গে পাটলিপুত্রে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ঘটনাক্রমে সেখানে তার সাথে তক্ষশীলার ব্রাহ্মণ পণ্ডিত চাণক্যের পরিচয় হয়। চন্দ্রগুপ্তের ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে চাণক্য (কৌটিল্য) তাকে সামরিক ও রাষ্ট্র বিদ্যায় শিক্ষিত করে তােলেন। সেই সময় পাটলিপুত্রে নন্দাজ ধননন্দ রাজত্ব করছিলেন।
আরো পড়ুন : বাংলা ভাষা ও সাহিত্য থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন ও উত্তর
নন্দরাজদের অত্যাচারী শাসনের বিরুদ্ধে নন্দসাম্রাজ্যের সর্বত্র জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। এদিকে উচ্চাকাক্ষী যুবক চন্দ্রগুপ্ত নন্দবংশের উচ্ছেদের চেষ্টা করেন। কোনাে কারণে নন্দ-রাজ কর্তৃক অপমানিত হওয়ায় চাণক্যও প্রতিশােধের উপায় খুঁজছিলেন। চাণক্য ও চন্দ্রগুপ্তের লক্ষ্য এক হওয়ায় উভয়েই সৈন্য সগ্রহ করে পাটলিপুত্র আক্রমণ করেন।
প্রথম দুটি আক্রমণে ব্যর্থ হলেও তৃতীয়বার সফল হন চন্দ্রগুপ্ত। যুদ্ধক্ষেত্রে ১০ হাজার হাতি, ১ লক্ষ অশ্বারােহী ও ৫.০০০ রথচালক নিহত হয়। ন-বংশের উচ্ছেদ করে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। মৌর্য অর্থ মুরার সন্তান চন্দ্রগুপ্ত বা চন্দ্রগুপ্ত প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ। মুরা ছিলেন চন্দ্রগুপ্তের মাতা মতান্তরে মাতামহী।
মৌর্য সাম্রাজ্য ১৩৮ বছর টিকেছিল। এর মধ্যে প্রথম তিন রাজা (চন্দ্রগুপ্ত ২৪ বছর, বিন্দুসার ২৭ বছর ও অশােক ৪১ বছর) মােট ৯২ বছর রাজত্ব করেন। পরবর্তী রাজাগণ রাজত্ব করেন ৪৬ বছর। এ সাম্রাজ্যের রাজাগণ হলেন
মেগাস্থিনিসের মতে সে যুগে পাটলিপুত্র ভারতের শ্রেষ্ঠ নগর ছিল। গঙ্গা ও সােম নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত এই নগরটি দৈর্ঘ্যে প্রায় সাড়ে নয় মাইল ও প্রস্থে দুই মাইলব্যাপী বিস্তৃত ছিল। চতুর্দিকে গভীর এক পরিখা ও সুউচ্চ প্রাচীর দিয়ে নগরটি পরিবেষ্টিত ছিল। প্রাচীরে ৫০০টি বুরুজ ও ৬৪টি তােরণ ছিল। নগরীর গৃহাদি কাঠ ও কাঁচা ইট দিয়ে নির্মিত হতাে। রাজপ্রাসাদ ছিল অপূর্ব কারুকার্যময়। প্রাসাদের চারদিকে মনােরম উদ্যান ও পুকুর ছিল। এটি বর্তমান ভারতের বিহার রাজ্যের রাজধানী। পাটনা শহরের সন্নিকটে অবস্থিত ছিল।
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পৌত্র ও বিন্দুসারের পুত্র সম্রাট অশােক খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৩-২৩২ পর্যন্ত সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি প্রথম জীবনে ছিলেন উজ্জয়িনীর শাসনকর্তা। ৪ খ্রিষ্টপূর্ব ২৬০ এ অশােক ওড়িষ্যার অংশ বিশেষ কলিঙ্গ ই রাজ্যের বিরুদ্ধে সসৈন্যে অগ্রসর হন। সেই সময় কলিঙ্গ ই রাজ্য সুবর্ণরেখা নদী থেকে গােদাবরী নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং একটি পরাক্রান্ত রাজ্যে পরিণত হয়, যা মৌর্য সাম্রাজ্যের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল।
আরো পড়ুন : বিসিএস প্রস্তুতির জন্য সাধারণ জ্ঞান বাংলাদেশ বিষয়াবলী থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তর
সুতরাং নিজের রাজ্যের নিরাপত্তা রক্ষার্থে অশােক কলিঙ্গ অভিযানে নামেন। এ যুদ্ধে দেড় লক্ষ লােক মারা যায় এবং বহুলােক বন্দি বা নিরুদ্দেশ হয়। কলিঙ্গ যুদ্ধের ভয়াবহ পরিণাম, কলিঙ্গবাসীর অপরিসীম দুর্দশা অশােকের মনে গভীর অনুশােচনার উদ্রেক করে। কলিঙ্গ যুদ্ধের পর অশােক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। অবশ্য অশােকে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের ফলে ভারতে ধর্মের ক্ষেত্রে বিশেষ পরিবর্তন না ঘটলেও রাজ্যের। শাসনতান্ত্রিক সংস্কার, জনকল্যাণমূলক কার্যাদিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রজাবান্ধব উদ্যোগ নেওয়া হয়।
অশােকের লিপিমালাই উপমহাদেশের প্রাচীনতম লিপি বলে সাধারণভাবে স্বীকৃত। অশােকের শিলালিপিগুলাে তিনভাগে ভাগ করা হয়। যথা— পর্বতলিপি, স্তম্ভ লিপি ও গুহার গায়ে খােদাই করা লিপি। শিলালিপিগুলি ব্রাহ্মী ও খরােষ্টি অক্ষরে লিখিত। অশােক ১৪টি প্রধান প্রস্তরলিপি খােদাই করেন। লাল লিপিগুলি থেকে জানা যায় কলিঙ্গ যুদ্ধের বিবরণ, কলিঙ্গ যুদ্ধ পরবর্তী প্রতিক্রিয়া, অশােকের ধর্মনীতি, শাসন ব্যবস্থা, তল্কালীন সমাজ ব্যবস্থা ইত্যাদি।
মৌর্য যুগে সকল শ্রেণির লােকেরা সুষ্ঠু জীবন-যাপন করত। সাধারণ লােকেরা ছিল শান্ত, সৎ ও কষ্টসহিষ্ণু। বুদ্ধিজীবী ও অভিজাত সম্প্রদায় ছাড়া ভারতের জনসমাজ সে যুগে চারটি প্রধান শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল, যথা— কৃষক, পশুপালক, ব্যবসায়ী ও শিল্পী। চরি, ডাকাতি সে যুগে ছিল না বললেই চলে। জনসাধারণের মধ্যে মদ্যপানের প্রচলন ছিল। আইনের কোনাে জটিলতা ছিল না। মােটামুটি সকল শ্রেণির লােকেরা শান্তিপ্রিয় ছিল।
FACT FILE | |
সময়কাল | ৩২৪-১৮৬ খ্রিষ্টপূর্ব |
প্রতিষ্ঠাতা | চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য |
সরকার | রাজতন্ত্র |
প্রথম সম্রাট | চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য |
শেষ সম্রাট | বৃহদ্রথ |
শ্রেষ্ঠ সম্রাট |
অশােক |
রাজধানী |
পাটলিপুত্র |
পূর্ববর্তী সাম্রাজ্য |
নন্দ সাম্রাজ্য |
পরবর্তী সাম্রাজ্য |
শুঙ্গ সাম্রাজ্য |
মৌর্য শব্দের অর্থ |
মুরার সন্তান চন্দ্রগুপ্ত |
সীমানা | উত্তরে হিমালয়, পূর্বে আসাম, পশ্চিমে বালুচিস্তান ও হিন্দুকুশ পর্বতমালা দক্ষিণে সমগ্র দক্ষিণ ভারত। |
মহাস্থানগড়ের নিকটবর্তী স্থানে প্রাপ্ত একটি শিলালিপির ভাষ্য হতে বাংলাদেশে মৌর্য শাসন বিস্তৃত হয় বলে ধরা হয়। এই লিপির ভাষ্য বিশ্লেষণ করে পুবর্ধন ভূক্তিটির রাজধানী হিসেবে আজকের বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়কে চিহ্নিত করা হয়। পুণ্ড্রবর্ধনের তখনকার নাম ছিল ‘পুণ্ড্রনগর।
আরো পড়ুন : বিসিএস প্রস্তুতির জন্য বাংলা সাহিত্য থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তর
মহাস্থান ব্রাহ্মী শিলাফলক প্রকৃতপক্ষে একটি রাজাদেশ যা পুণ্ড্রনগরের ‘মহামাত্র’ পদবিধারী শাসকের উদ্দেশ্যে জারি করা হয়। এ আদেশের মাধ্যমে পুণ্ড্রনগরের মহামাত্রকে দুর্ভিক্ষ পীড়িত নিখিল বঙ্গবাসীকে শস্যাগার থেকে ধান ও কোষাগার থেকে মুদ্রা দিয়ে সাহায্য করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। এই আদেশটি প্রাকৃত ভাষায় ব্রাহ্মী অক্ষরে সম্রাট অশােকের বলে মনে করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের সব থেকে বড় ও প্রাচীন দুর্গনগরী হিসেবে পুণ্ডনগরীর ধ্বংসাবশেষকে চিহ্নিত করা হয়েছে। বগুড়া শহরের প্রায় ১৩ কিমি উত্তরে অবস্থিত এই নগরীর ধ্বংসাবশেষটি নদীর সমতল থেকে আনুমানিক ৬ মিটার উঁচু প্রতিরক্ষা প্রাচীর দিয়ে চারদিকে বেষ্টিত।
চন্দ্রগুপ্ত ও কৌটিল্যের চেষ্টায় যে বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তা অশােকের মৃত্যুর প্রায় ৫০ বছরের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। বৃহদ্রথ ছিলেন মৌর্যবংশের শেষ রাজা। তিনি নিজ ব্রাহ্মণ সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ কর্তৃক নিহত হন। এর মাধ্যমেই মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন হয়। সাম্রাজ্যের পতন কোনাে আকস্মিক ঘটনা ছিল না। বিভিন্ন কারণে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটে অশােক কর্তৃক পশুবলির নিষিদ্ধকরণ, দণ্ড-সমতা, ব্যবহার সমতা ইত্যাদি নীতি ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের অধিকার ও মর্যাদা ক্ষুন্ন করেছিল।
ফলে ব্রাহ্মণরা পুষ্যমিত্র শুঙ্গের নেতৃত্বে বিদ্রোহী হয়ে মৌর্য বংশের। বিলােপ-সাধনে সহায়তা করে ও সাম্রাজ্যের বিশালতার কারণে কেন্দ্রীয় রাজশক্তির পক্ষে সর্বত্র আধিপত্য রক্ষা করা সম্ভব হয়নি ও অশােক পরবর্তী শাসকদের অত্যাচারে বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ দেখা দেয় ? অশােকের উত্তরাধিকারীদের দুর্বলতা ও পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা মৌর্য সাম্রাজ্যের তিনের অন্যতম কারণ।
মৌর্য যুগের একজন রাষ্ট্রনায়ক (প্রধানমন্ত্রী) হিসেবে যুগ, কাল, শতাব্দী শ্রেষ্ঠ এমনকি কালজয়ীগ্রন্থ অর্থশাস্ত্র রচনা করাটা ছিল কৌটিল্যের সবচেয়ে বড় অবদান। তিনি রাষ্ট্রের অঙ্গগুলােকে এমনভাবে সাতটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেন যেখানে কোনাে কিছুই বাদ ছিল না। অথচ বর্তমানে অর্ধশতাধিক বিভাগ মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করেও নাগরিকবৃন্দের কল্যাণ আনয়ন করা যাচ্ছে না।
কৌটিল্যের শাসনব্যবস্থায় রাজা, মন্ত্রী, অমাত্য, পুরােহিতসহ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সকল গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়ােগ লাভের জন্য নির্ধারিত গুণাবলির কথা বিবেচনা করা হয়। যাতে করে গুণমানসম্পন্ন, নৈতিকভাবে উঁচুমানের প্রশাসক দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনার সুযােগ সৃষ্টি হয়েছিল। বর্তমানে আমাদের দেশে সুশাসন নিশ্চিতকরণে তার এই শাসন ব্যবস্থা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হতে পারে।
অপরদিকে সম্রাট অশােক অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র বিষয়ে যে নীতি গ্রহণ করেন তার অভাবে এখনাে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে হানাহানি লেগেই আছে। তিনি ধর্মমঙ্গল দর্শন বা ধর্ম বিজয়ের মাধ্যমে যেভাবে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক সহিষ্ণুতা বজায় রাখতে পেরেছিলেন তা এখনও শিক্ষণীয় হয়ে আছে। আধুনিক সময়ে সুশাসনের যেসব বৈশিষ্ট্য ও আদর্শের কথা বলা হচ্ছে তার বহুলাংশেই প্রাচীন ভারতের এই দুটি ও শাসন ব্যবস্থায় সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়।
কৌটিল্য ছিলেন একজন প্রাচীন ভারতীয় অর্থনীতিবিদ, দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। তিনি তক্ষশীলার ব্রাহ্মণ আচার্য ও বিষ্ণুর উপাসক ছিলেন। চাণক্যের সহায়তায় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য একটি সুবিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে তিনি চন্দ্রগুপ্তের প্রধানমন্ত্রী এবং বিন্দুসারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। চাণক্য বা কৌটিল্য রচিত ‘অর্থশাস্ত্র একটি কালজয়ী গ্রন্থ। ১৫টি বিভাগ ও ১৮০টি উপবিভাগে বিভক্ত এ গ্রন্থে প্রায় ৬০০০ শ্লোক রয়েছে।
১৯০৫ সালে আবিষ্কৃত এ গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯০৯ সালে। এ গ্রন্থে সরকারের সমস্যাবলি ও সরকারি প্রশাসনিক যন্ত্র ও কার্যাবলি সম্পর্কে আলােচনা রয়েছে। এ অর্থশাস্ত্রে রাজ্যের অর্থনৈতিক স্বার্থকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যে সাতটি উপাদানের ভিত্তিতে রাষ্ট্রব্যবস্থা বিন্যস্ত হয় সেগুলাে হলাে— স্বামী, অমাত্য, জনপদ, দুর্গ, কোশ, বল ও মিত্র। এগুলাের মধ্যে কৌটিল্য, কোশ বা অর্থভাণ্ডারকে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রধান ভিত্তি রূপে চিহ্নিত করেন। অর্থশাস্ত্রে রাষ্ট্রশাসন নীতি, মৌর্যযুগে রাষ্ট্র ব্যবস্থার চরিত্র ও ভিত্তি সম্পর্কে আলােচনা ছাড়াও বিধবা বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদসহ নারীদের সম্পর্কেও বিস্তৃত আলােচনা রয়েছে।
Leave a Comment