১৯৫৩ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজাম-এ-ইসলাম, বামপন্থী গণতন্ত্রী দল- এ চারটি বিরােধী রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রচারণা ২১ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে পরিচালিত হয়।
একুশ দফার প্রধান দফা ছিল পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন। অন্যান্য উল্লেখযােগ্য দফাগুলাে ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদান, বর্ধমান হাউসকে বাংলা একাডেমীতে রূপান্তর, ভাষা আন্দোলনের শহীদের জন্য শহীদ মিনার নির্মাণ, ২১শে ফেব্রুয়ারিকে সরকারি ছুটির দিন ঘােষণা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলােকে আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা, শ্রমিকদের অধিকারের স্বীকৃতি, পাটশিল্প জাতীয়করণ, পাটচাষিদের ন্যায্য মূল্য প্রদান, বন্যানিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ, সেচ পরিকল্পনা গ্রহণ, বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন ইত্যাদি।
যুক্তফ্রন্ট- এর নেতৃত্বে ছিলেন এ. কে. ফজলুল হক, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, মাওলানা আতাহার আলী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নির্বাচনী সফরকালে তাঁরা ২১ দফা কর্মসূচি প্রচার করেন এবং জনগণকে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে অনুপ্রাণিত করে তােলেন।
সর্বজনীন ভােটাধিকার এবং স্বতন্ত্র নির্বাচকমণ্ডলী- এ ভিত্তিতে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে। যুক্তফ্রন্ট প্রাদেশিক আইন পরিষদের মােট ৩০৯টি আসনের মধ্যে এককভাবে ২২৩টি আসন লাভ করে। অন্যান্য আসনগুলাের মধ্যে মুসলিম লীগ ৯টি আসন, নির্দলীয় সদস্যগণ ৪টি এবং খেলাফত রাব্বানী ১টি আসন লাভ করে। এ নির্বাচনে ৭২টি আসন অমুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষিত ছিল।
১। এ নির্বাচনের গুরুত্ব অপরিসীম। এ নির্বাচনে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণীর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
২। এ নির্বাচন ছিল মূলত পূর্ব বাংলার জনতার বিজয়। তাদের এ জাতীয়তাবাদী চিন্তা-চেতনার ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য হয়।
৩। এ নির্বাচন প্রমাণ করেছে জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। জনগণই এ নির্বাচনে মুসলিম লীগকে প্রত্যাখ্যান করে।
৪। এ নির্বাচনে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকলেই ঐক্যবদ্ধ ছিল।
৫। এ নির্বাচন পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগের শাসনের অবসান ঘটায়।
নির্বাচনের পর ২৫শে মার্চ পূর্ব বাংলায় গভর্নর চৌধুরী খালেকুজ্জামান ফজলুল হককে মন্ত্রিসভা গঠনের আহ্বান জানান। ২রা এপ্রিল যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। পরে তা সম্প্রসারিত হয়। এর সর্বমােট সদস্যসংখ্যা ছিল ১৪ জন। হক সাহেব হলেন মুখ্যমন্ত্রী। নেতৃবৃন্দের মধ্যে ব্যক্তিগত রেষারেষি এবং মন্ত্রিত্ব নিয়ে বিরােধ দেখা দেয়। তদুপরি মুসলিম লীগের চক্রান্তে যুক্তফ্রন্ট বেশি দিন টিকতে পারেনি।
১৯৫৪ সালের মে মাসে ফজলুল হক কলকাতা ভ্রমণে গিয়ে অসতর্কভাবে এমন সব বক্তব্য রাখেন যা পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠীর কাছে গ্রহণযােগ্য ছিল না। ইতিমধ্যে আদমজি জুট মিলস এবং চন্দ্রঘােনা পেপার মিলে বাঙালি ও বিহারি শ্রমিকদের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হয়। এতে বহু শ্রমিক নিহত হয়। এ অজুহাতে ১৯৫৪ সালের ৩০শে মে কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিল ঘােষণা করে। এভাবে পূর্ব বাংলায় সংসদীয় গণতন্ত্রের অবসান হয়।
Leave a Comment