প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর প্রথম উপন্যাস ‘লালসালু’। এটি একটি সামাজিক সমস্যামূলক উপন্যাস। উপন্যাসটি লেখকের দুঃসাহসী প্রচেষ্টার সার্থক ফসল। ঢাকা ও কলকাতার মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবন তখন নানা ঘাত-প্রতিঘাতে অস্থির।
ব্রিটিশ শাসনবিরােধী আন্দোলন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তেতাল্লিশের মন্বন্তর, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশবিভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা, আবার নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান গড়ে তােলার উদ্দীপনা হত্যার নানারকম সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আবর্তে মধ্যবিত্তের জীবন তখন বিচিত্রমুখ জটিলতায় বিপর্যস্ত ও উজ্জীবিত।
নবীন লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এ চেনা জগৎকে বাদ দিয়ে তার প্রথম উপন্যাসের জন্য গ্রামীণ পটভূমির সমাজ-পরিবেশকে বেছে নিলেন। উপন্যাসের বিষয় সামাজিক রীতি-নীতি ও প্রচলিত ধারণা-বিশ্বাস চরিত্রসমূহ একদিকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মভীরু, শােষিত, দরিদ্র গ্রামবাসী; অন্যদিকে, শঠ, প্রতারক, ধর্মব্যবসায়ী এবং শােষক-ভূস্বামী।
গ্রামবাসীর সরলতা ও ধর্মবিশ্বাসের সুযােগ নিয়ে ভণ্ড ধর্মব্যবসায়ী মজিদ প্রতারণার জাল বিস্তারের মাধ্যমে কীভাবে নিজের শাসন ও শােষণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে তারই বিবরণে সমৃদ্ধ এ উপন্যাস। কাহিনিটি ছােট, সাধারণ ও সামান্য; কিন্তু এর গ্রন্থনা ও বিন্যাস অত্যন্ত মজবুত। উপন্যাসটি শিল্পিত সামাজিক দলিল হিসেবে বাংলা সাহিত্যের একটি অবিস্মরণীয় সংযােজন।
গ্রন্থ সংক্ষেপ
শ্রাবণের শেষে নিরাক পড়া এক মধ্যাহ্নে মহব্বতনগর গ্রামে মজিদের প্রবেশের নাটকীয় দৃশ্যের মধ্য দিয়ে উপন্যাসের। শুরু। এরপর গ্রামের মাতব্বর খালেক ব্যাপারীর বাড়িতে সে সমবেত গ্রামের মানুষকে তিরস্কার করেছে, আপনারা জাহেল, বেএলেম, আনপাড়হ। মােদাচ্ছের পিরের মাজার আপনারা এমন করি ফেলি রাখছেন?’ অলৌকিকতার অবতারণা করে মজিদ জানায় যে, পিরের স্বপ্নদেশে মাজার তদারকির জন্য এ গ্রামে তার আগমন।
মজিদের তিরস্কার ও স্বপ্নাদেশের বিবরণ শুনে গ্রামের মানুষ ভয়ে এবং শ্রদ্ধায় বিগলিত হয়ে গভীর আগ্রহে তার প্রতিটি হুকুম পালন করে। গ্রাম প্রান্তের বাঁশঝাড় সংলগ্ন কবরটি দ্রুত পরিচ্ছন্ন করে। ঝালরওয়ালা লালসালুতে ঢেকে দেওয়া হয়। কবরটি অচিরেই মাজারে এবং মজিদের শক্তির উৎসে পরিণত হয়।
এই বিভাগ থেকে আরো পড়ুন
- ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ : সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্
- বন্দী শিবির থেকে : শামসুর রাহমান
- পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় : সৈয়দ শামসুল হক
- চিলেকোঠার সেপাই সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য
- ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস
মজিদের স্বগত সংলাপ থেকে জানা যায়, শস্যহীন নিজ অঞ্চল থেকে ভাগ্যান্বেষণে বেরিয়ে-পড়া মজিদ নিজ অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে এমন মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। মাজারের আয় দিয়ে অল্প দিনের মধ্যে মজিদ ঘরবাড়ি ও জমিজমার মালিক হয়ে যায় এবং তার মনােভূমির এক অনিবার্য আকাঙ্ক্ষায় বিধবা যুবতী রহিমাকে বিয়ে করে।
নিঃসন্তান মজিদের সন্তান-কামনাসূত্রে তার দ্বিতীয় স্ত্রীরূপে আগমন ঘটে জমিলার। প্রতিষ্ঠা লাভের সাথে সাথে মজিদ ধর্মকর্মের পাশাপাশি সমাজেরও কর্তা ব্যক্তি হয়ে ওঠে। গ্রামের মানুষের দৈনন্দিন জীবনে উপদেশ দেয় এবং গ্রাম্য বিচার-সালিশিতে সে-ই হয়ে ওঠে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী প্রধান ব্যক্তি। এক্ষেত্রে মাতব্বর খালেক ব্যাপারীই তার প্রধান সহায়ক শক্তি। ধীরে ধীরে সে গ্রামবাসীর পারিবারিক জীবনেও প্রভাব বিস্তার করে।
তাহেরের বাপ-মার মধ্যকার একান্ত পারিবারিক বিবাদকে কেন্দ্র করে তাহেরের বাপের কর্তৃত্ব নিয়েও প্রশ্ন তােলে। নিজ মেয়ের গায়ে হাত তােলার অপরাধে মেয়ের কাছে মাফ চাওয়ায়। অপমান সহ্য করতে না পেরে তাহেরের বাপ শেষ পর্যন্ত নিরুদ্দেশ হয়।
খালেক ব্যাপারীর নিঃসন্তান স্ত্রী আমেনা সন্তান কামনায় অধীর হয়ে মজিদের প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ালপুরের পিরের প্রতি আস্থাশীল হলে মজিদ তাকেও শাস্তি দিতে পিছপা হয়না।
আমেনা চরিত্রে কলঙ্ক আরােপ করে খালেক ব্যাপারীকে দিয়ে তাকে তালাক দিতে বাধ্য করে মজিদ। গ্রামবাসী যাতে শিক্ষার আলােয় আলােকিত হয়ে মজিদের মাজারকেন্দ্রিক পশ্চাৎপদ জীবন ধারা থেকে সরে যেতে না পারে, সেজন্য সেশিক্ষিত ও প্রতিবাদী যুবক আক্কাসের স্কুল প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে দেয়। এভাবে একের পর এক ঘটনার মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক গ্রাম, সমাজ ও মানুষের বাস্তবচিত্র ‘লালসালু উপন্যাসে ফুটিয়ে তুলেছেন।
লেখক পরিচিতি
- জন্ম » ১৫ আগস্ট ১৯২২, মােলশহর চট্টগ্রাম (আদি নিবাস নােয়াখালী)।
- উপন্যাস » লালসালু (১৯৪৮), চাঁদের অমাবস্যা (১৯৬৪), কাঁদো নদী কাঁদো (১৯৬৮)।
- ছােটগল্প » নয়নচারা (১৯৪৬), দুই তীর ও অন্যান্য গল্প (১৯), গল্প-সমগ্র (১৯৭২)।
- নাটক » সুড়ঙ্গ (১৯৬৪), তুরঙ্গভঙ্গ (১৯৬৪), বহিপীর (১৯৬৩), উজানে মৃত্যু (১৯৬৬)।
- পুরস্কার » বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬১), আদমজী পুরস্কার (১৯৬৫), একুশে পদক (১৯৮৩)।
- মৃত্যু » ১০ অক্টোবর ১৯৭১; প্যারিস, ফ্রান্স।
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন
- ‘লালসালু’ উপন্যাসের লেখক কে?— সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্।
- ‘লালসালু উপন্যাসের রচনাকাল কোনটি?— ১৯৪৮।
- ‘লালসালু’ উপন্যাসের উপজীব্য বিষয় হলাে— ধর্মীয় ভণ্ডামির নিখুঁত চিত্র।
- Tree without Roots’ কোন গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ?— লালসালু।