সামাজিকীকরণের সংজ্ঞা
একটি শিশু যখন জন্মায়, তখন সে একান্তই ইন্দ্রিয়সব প্রাণী। কারণ সে তখন ইন্দ্রিয় দ্বারা তাড়িত হয়। কিন্তু আতে আতে সে নানাভাবে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার দ্বারা সমাজের উপযুক্ত সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ প্রক্রিয়াকে সামাজিকীকরণ বলে। সামাজিকীকরণ একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া।
শিশুর জন্মের পর হতে মৃত্যু পর্যন্ত এ প্রক্রিয়া চলতে থাকে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যক্তি যখন এক পর্যায় হতে আরেক পর্যায়ে প্রবেশ করে তখন তাকে নতুন পরিবেশের সঙ্গে, নতুন অবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হয়। এ খাপ খাওয়ানাে প্রক্রিয়ার ফলে তার আচরণে পরিবর্তন আসে। নতুন নিয়মকানুন, রীতিনীতি এবং নতুন পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে চলার প্রক্রিয়ার নাম সামাজিকীকরণ।
আরো পড়ুন : সমাজ কী? সমাজের উপাদান গুলো কি কি আলোচনা কর
সমাজবিজ্ঞানী কিংসলে ডেভিস -এর মতে, “সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার দ্বারা ব্যক্তি পুরােপুরি সামাজিক মানুষে পরিণত হয়। এ প্রক্রিয়া ছাড়া ব্যক্তি তার ব্যক্তিত্ব লাভে ব্যর্থ হয় এবং সমাজে সে একজন যােগ্য ও উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে না।”
অগবার্ন ও নিমকফ বলেন যে, “সামাজিকীকরণ ছাড়া সমাজে জীবনযাপন একেবারেই সম্ভব নয় এবং সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার দ্বারা ব্যক্তি তার গােষ্ঠীর সঙ্গে মেলামেশায় সামাজিক মূল্য বজায় রাখে।” উপরিউক্ত আলােচনা হতে দেখা যায় সামাজিকীকরণ এমন একটি প্রক্রিয়া যার দ্বারা মানবশিশু ক্রমশ ব্যক্তিত্বপূর্ণ সামাজিক মানুষে পরিণত হয়।
সামাজিকীকরণের বিভিন্ন মাধ্যম
শিশুর সামাজিকীকরণের বিভিন্ন মাধ্যম রয়েছে, যথা- শিশুর পিতামাতা বা পরিবার, খেলার সাথি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সংস্কৃতি ইত্যাদি। নিম্নে সামাজিকীকরণের মাধ্যমগুলাে বর্ণনা করা হল।
পরিবার :
সামাজিকীকরণের কতগুলাে মাধ্যম রয়েছে তার মধ্যে পরিবারের ভূমিকাই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। বলা হয়ে থাকে যে, শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশের পথে বংশগতি মূল উপাদান জোগায়, সংস্কৃতি নকশা তৈরি ক হ পরিবারে পিতামাতা কারিগর হিসেবে কাজ করে। কারণ শিশুর সমস্ত দৈহিক, মানসিক, বস্তুগত ও অবগত যাবতীয় প্রয়ােজন মেটায় পরিবার।
পরিবারেই শিশু তার চিন্তা, আবেগ ও কর্মের অভ্যাস গঠন করে। মূলত শিশুর চরিত্রের ভিত্তিপ্রস্তর রচিত হয় পরিবারেই। কীভাবে কথা বলতে হয়, নিজের আবেগ কিভাবে প্রকাশ করা হয় তা শিশু পরিবার হতেই শিক্ষালাভ করে। অর্থাৎ ভবিষ্যৎ জীবনযুদ্ধে সে যেন বাস্তবতার মুখােমুখি হতে পারে তার জন্য পূর্ব হতেই পরিবার তাকে শিক্ষা প্রদান করে।
আরো পড়ুন : সংস্কৃতি কী? সংস্কৃতির উপাদান
পরিবার শিশুর অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করে থাকে। শিশুর চলাফেরা, কথাবার্তা, ভাষা শিক্ষা দেওয়া, আচার-আচরণ শিক্ষা দেওয়া, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা দান করার দায়িত্ব একমাত্র পরিবারের। সমাজের একজন যােগ্য ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে গড়ে তােলার জন্য পরিবারের অবদান সবচেয়ে বেশি। সুতরাং শিশুর ব্যক্তিত্ব নির্ভর করে তিনটি সম্পর্কের ওপর, যথা-
- পিতা-মাতার মধ্যে সম্পর্ক
- পিতা-মাতা ও শিশুর মধ্যে সম্পর্ক এবং
- পরিবারের শিশুদের মধ্যে সম্পর্কের ওপর।
পিতা-মাতার মধ্যে সম্পর্ক মধুর হলেই সে পরিবারের শিশুরা সুন্দর পারিবারিক পরিবেশে নিজেদের ব্যক্তিত্ব গঠন করতে সক্ষম হয়। অপরদিকে পিতামাতার মধ্যে ঝগড়া বিবাদ, বিবাহ-বিচ্ছেদ, মারামারি বা পারিবারিক অশান্তি বিরাজ করলে সে পরিবারের শিশুদের মধ্যে মনােদৈহিক সমস্যা দেখা দেয় এবং ঐসব শিশুরা নানা প্রকার অপরাধকর্মে লিপ্ত হয়।
পিতামাতা ও শিশুদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজ করলে পরবর্তীকালে ঐ শিশুরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে গড়ে ওঠে এবং সমাজে সহজ জীবনযাপন করতে পারে। পরিবারের শিশুদের মধ্যে কেমন সম্পর্ক বিরাজ করবে তার ওপর ভিত্তি করে সে পরিবারের শিশুদের ব্যক্তিত্ব গঠিত হবে। সুতরাং শিশুর সামাজিকীকরণের সংস্থা হিসেবে পরিবারের পক্ষে যা করা সম্ব, অন্য কোনাে সংস্থার পক্ষে তা অচিন্তনীয়।
খেলার সাথি :
শিশুর সামাজিকীকরণে তার সঙ্গী বা খেলার সাথিরা শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। শিশু তার খেলার সাথিদের সঙ্গে মেলামেশা করলে তার মধ্যে নেতৃত্ব দেওয়ার গুণাবলির পরিস্ফুটন হয়। সে স্বাবলম্বী হতে শেখে। অন্যদিকে কিশাের অপরাধী হওয়ার অন্যতম কারণ হল খেলার সাথি।
আরো পড়ুন : সমাজবিজ্ঞান কি বা সমাজবিজ্ঞান বলতে কি বুঝ? সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতা
গবেষণায় দেখা গেছে যেসব শিশু রেললাইন, রাস্তা, অলিগলি, বস্তিতে ঘুরে বেড়ায় ও খেলাধুলা করে তারা পরবর্তীকালে বিভিন্নরকম অপরাধমূলক কাজে বেশি লিপ্ত হয়। অর্থাৎ একটা শিশুকে অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত করার ব্যাপারে খেলার সাথি বা সঙ্গীসাথি খুব শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে।
ধর্ম :
ধর্মীয় অনুশাসন মানুষের জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। যে ব্যক্তি যে ধর্মে বিশ্বাসী সে ব্যক্তি সে ধর্মের রীতিনীতি ও বিধানসমূহের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে। শৈশবকাল হতে যে ব্যক্তি যে ধর্মে বিশ্বাসী সে ব্যক্তি সে ধর্মীয় মূল্যবােধ দ্বারা লালিত হয় এবং সে ধর্মীয় বৈশিষ্ট্যগুলাে পরবর্তীকালে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে প্রতিফলিত হয়।
ধর্ম মানুষের মনে সামাজিক মূল্যবোেধ সঞ্চারিত করে, সত্যবাদিতা, কর্তব্যপরায়ণতা, ন্যায়পরায়ণতা, সহমর্মিতা প্রভৃতি গুণে গুণান্বিত হতে শিক্ষা দেয়। ধর্ম মানুষকে মন্দপথ পরিহার করে সৎপথে চলার নির্দেশ দেয়, আচরণে সৎ ও ন্যায়পরায়ণ হতে শিক্ষা দেয়। এক কথায় ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ব্যক্তির সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান :
সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদিও পরিবারের মধ্য দিয়েই শিশুর যে সামাজিকীকরণ শুরু হয় বিদ্যালয়ের মাধ্যমে সে প্রক্রিয়ার অবিচ্ছিন্নতা বজায় থাকে। সমাজের সভ্যরা যাতে সামাজিক মূল্য, সামাজিক আদর্শ, সামাজিক অভ্যাসগুলাে আয়ত্ত করতে পারে তার জন্য প্রতিটি সমাজকে তার শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে সমাজের প্রতিটি সভ্যকে তার নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করার জন্য শিক্ষা দান করতে হয়।
সমাজ তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিশু-কিশােরদেরকে সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞান দান করে। সমাজে বসবাস করতে হলে প্রত্যেক ব্যক্তিকে কতকগুলাে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয়। ব্যক্তির মধ্যে দায়িত্ববােধ ও সামাজিক চেতনা না থাকলে সে এ দায়িত্ব পালন করতে পারে না।
শিক্ষার দ্বারাই ব্যক্তির মনে এ দায়িত্ববােধ ও সামাজিক চেতনা সৃষ্টি করা যেতে পারে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মানুষকে নানাভাবে শিক্ষাদান করে মানুষের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া সার্থক করে তােলে। তাছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আচার-অনুষ্ঠান, আইন-কানুন, পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষক-শিক্ষিকা শিশুর মনে মূল্যবােধ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
সামাজিকীকরণে গণমাধ্যমের ভূমিকা :
গণমাধ্যমসমূহ যেমন- সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, বেতার, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র সামাজিকীকরণে গৌণ ভূমিকা পালন করে। কারণ, সামাজিকীকরণের বাহন হিসেবে পরিবার, খেলার সাথি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানত মৌলিক ভূমিকা পালন করে। নিচে বিভিন্ন ধরনের গণমাধ্যমের ভূমিকা বর্ণনা করা হল।
সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন :
সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, জার্নাল প্রভৃতি গণমাধ্যমে পরিবেশিত তথ্যসমূহ সমাজের মূল্যবােধ, প্রথা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সম্পর্কে আলােচিত হয়। এছাড়া সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনে এমন কতকগুলাে শিক্ষামূলক তথ্য প্রচার করা হয় যার দ্বারা শিশু-কিশাের, এমনকি যেকোনাে ব্যক্তির সামাজিকীকরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
বেতার :
বেতারযন্ত্র আজকাল সহজলভ্য হওয়ায় সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে এর ভূমিকা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের দেশের গ্রামীণ জনগােষ্ঠীর বিনােদনের মুখ্য মাধ্যম হল বেতার। সে কারণে এ মাধ্যমটি নানা ধরনের বিনােদনমূলক ও শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যমে ব্যক্তির সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে।
টেলিভিশন :
দর্শন ও শ্রবণ-ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে একই সাথে তথ্য সংগৃহীত হওয়ায় অন্যান্য গণমাধ্যমের তুলনায় টেলিভিশনে পরিবেশিত তথ্য সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে অধিক কার্যকরি ভূমিকা পালন করে। সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশীয় সংস্কৃতির অনুকূলে নানা ধরনের শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান পরিবেশন করে টেলিভিশন সামাজিকীকরণে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে।
চলচ্চিত্র :
চলচ্চিত্র সামাজিকীকরণের বাহন হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে যদি তা শুধুমাত্র বিনােদনধর্মী হয়ে আদর্শ ও বাস্তবধর্মী শিক্ষামূলক চলচ্চিত্র হয়। এ ধরনের চলচ্চিত্র জনগণের ব্যক্তিত্বপূর্ণ মনােভাব গঠনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
সামাজিকীকরণে গণমাধ্যমের যেমন ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে, তেমনি আছে এর নেতিবাচক ভূমিকা। বর্তমানে শহর এলাকা এমনকি মফস্বল এলাকাতেও ডিশ এন্টেনা, ভিসিপি, ভিসিআর, বিদেশি ম্যাগাজিন প্রভৃতির মাধ্যমে বিদেশি অপসংস্কৃতি এদেশের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করছে।