সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য
সামাজিক সমস্যার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যের আলােচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা সামাজিক সমস্যার উৎপত্তি ঘটে সামাজিক বিশৃঙ্খলা হতে। প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইম-এর (Emile Durkheim) মতে, “সামাজিক বিশৃঙ্খলার অর্থ ব্যক্তির ওপর সামাজিক রীতিনীতির প্রভাব হ্রাস পাওয়া” । অর্থাৎ সামাজিক রীতিনীতি যখন ব্যক্তির আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয় তখন মানুষের নৈতিক অবনতি শুরু হয়। নৈতিক অবনতি ব্যাপক আকার ধারণ করলে সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ভাঙন শুরু হয়।
সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ভাঙনের ফলে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য দেখা দেয়। এসব পরিস্থিতিতে সমাজে নানা ধরনের সামাজিক সমস্যার পরিমাণ বাড়তে থাকে। সমাজবিজ্ঞানী অগবার্ন ও নিম্ক (Ogburn and Nimkoff) সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যের জন্য সমাজে বস্তুগত ও অবস্তুগত সংস্কৃতির অসম পরিবর্তনকে দায়ী করেন। কোনাে সমাজ বিশৃঙ্খল কিনা তা জানা যায় সে সমাজের সামাজিক বিশৃঙ্খলার কতকগুলাে লক্ষণ দেখে।
আরো পড়ুন : সামাজিক পরিবর্তন, সামাজিক পরিবর্তনের সংজ্ঞা , বৈশিষ্ট্য ও বিভিন্ন উপাদান
যেমন- অপরাধ, কিশাের অপরাধ, পতিতাবৃত্তি, মাদকাসক্তি, আত্মহত্যার প্রবণতা, বিবাহ বিচ্ছেদ, অবৈধ সন্তান জন্মদান, যৌনব্যাধি, স্বেচ্ছাচার, শিশুশ্রম, শিশুদের প্রতি অবহেলা, নির্ভরশীলতা, নারী নির্যাতন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, রাজনৈতিক ও সামাজিক দুর্নীতি, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, ঘুষ, ছিনতাই, সন্ত্রাস, হত্যা, রাহাজানি, চাঁদাবাজি, ইত্যাদি হল সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যের লক্ষণ।
সামাজিক বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য এবং সামাজিক মূল্যবােধের অবক্ষয়ের কারণ
সামাজিক অসংগতি প্রায় সব সমাজেই দেখা যায়। কোনাে সমাজে বেশি, আবার কোনাে সমাজে অপেক্ষাকৃত কম। সামাজিক অসংগতির কারণগুলাে নিচে বর্ণিত হল।
- জটিল শ্রমবিভাগ : জটিল শ্রমবিভাগের ফলে সমাজে বিশৃঙ্খলা বা অসংগতি দেখা দেয়। এ প্রসঙ্গে ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী ডুর্খেইম (Durkheim) বলেন যে, জটিল শ্রমবিভাগের ফলে সামাজিক অসংগতির উদ্ভব হয়। সীমাহীন সামাজিক শ্রমবিভাগের ফলে সামাজিক ভারসাম্যের অভাব ঘটে বলে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।
- সামাজিক রীতিনীতির প্রভাব হ্রাস : সামাজিক অসংগতির অর্থ ব্যক্তির ওপর সামাজিক রীতিনীতির প্রভাব হ্রাস পাওয়া। অর্থাৎ সামাজিক রীতিনীতি যখন ব্যক্তির আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয় তখন মানুষের নৈতিক অবক্ষয় দেখা দেয়। এর ফলে সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ভাঙন শুরু হয়। সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ভাঙনের ফলে সামাজিক অসংগতি দেখা দেয়।
- সামাজিক মূল্যবােধের অবক্ষয় : সমাজে প্রচলিত বিশ্বাস, আদর্শ, চিন্তাভাবনা যার দ্বারা সামাজিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রিত হয় সে গুলাের সমষ্টিই হল সামাজিক মূল্যবোেধ। এসব প্রচলিত মূল্যবােধের অবক্ষয়ই সামাজিক অসংগতির অন্যতম কারণ।
- সংস্কৃতি অসম অগ্রগতি : সমাজবিজ্ঞানী অগবার্ন (Ogburn)-এর মতে, সংস্কৃতির বিভিন্ন অংশের পরিবর্তনের অসংগতির ফলে সামাজিক অসংগতি দেখা দেয়।
- প্রাকৃতিক দুর্যোগ : মানুষের পরিবেশের পরিবর্তন, মহামারী, ভূমিকম্প, বন্যা, যুদ্ধ প্রভৃতি কারণে সমাজে বিশৃঙ্খলা বা অসংগতি দেখা যায়।
আরো পড়ুন : সমাজ কাঠামাে, সমাজ কাঠামাের সংজ্ঞা ও সমাজ কাঠামাের উপাদান
নৈরাজ্য
সাধারণত সামাজিক বিশৃঙ্খলা যখন চরমে পৌঁছে তখন সমাজে নৈরাজ্য দেখা দেয়। নৈরাজ্য বলতে সমাজের শৃঙ্খলার অভাবকে বােঝানাে হয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রের যখন শাসনযন্ত্র আর কাজ করে না এবং শাসনযন্ত্র ব্যক্তির বা গােষ্ঠীর আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না তখন সমাজে নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়। সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টির পেছনে যেসব কারণ দায়ী তা নিম্নে বর্ণনা করা হল।
- মূল্যবােধের অবক্ষয় : সামাজিক মূল্যবােধের অবক্ষয়ই সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টির জন্য দায়ী।
- আইন-শৃঙ্খলার অবনতি : সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টির অন্যতম কারণ হল আইন-শৃঙ্খলায় অবনতি এবং শিথিলতা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার বৈষম্যমূলক আইন প্রয়ােগ এবং তাদের আচরণ সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে।
- অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ : বিজাতীয় সাংস্কৃতিক অনুপ্রবেশ ও আগ্রাসন আমাদের সমাজজীবনে হতাশা ও নৈরাজ্য ডেকে আনে।
- রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দুর্নীতি : রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দুর্নীতি এদেশে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অন্যতম কারণ।
সামাজিক মূল্যবোেধ
সমাজ কাঠামাের অবিচ্ছেদ্য উপাদান হল মূল্যবোেধ। যেসব ধ্যানধারণা, বিশ্বাস, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, সংকল্প মানুষের আচার-আচরণ এবং কার্যাবলিকে পরােক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে সেগুলাের সমষ্টিই হল মূল্যবোেধ। মনােবিজ্ঞানী Sherif-এর মতে, “যেকোনাে সমাজের রীতিনীতি, মনােভাব এবং সমাজের অন্যান্য অনুমােদিত ব্যবহারের সমন্বয়ে সামাজিক মূল্যবােধের সৃষ্টি হয়। যেমন- স্নেহ, মায়ামমতা, সততা, বড়দের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া ইত্যাদি হল সামাজিক মূল্যবােধের উদাহরণ।
আরো পড়ুন : সামাজিক স্তরবিন্যাস, সামাজিক স্তরবিন্যাসের সংজ্ঞা ও সামাজিক স্তরবিন্যাসের বৈশিষ্ট্য ও প্রকারভেদ
সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে মূল্যবােধেরও পরিবর্তন হয়। বিশেষ করে প্রযুক্তিগত বিদ্যা, শহরায়ন এবং শিল্পায়নের ফলে মূল্যবােধের পরিবর্তন ঘটে। এর কারণগুলাে নিম্নে বর্ণনা করা হল :
- ন্যায়বিচারের অভাব : ন্যায়বিচারের অভাবে সমাজে বিশৃঙ্খলা বা অসংগতি বৃদ্ধি পায়। ফলে সামাজিক মূল্যবােধের অবক্ষয় দেখা যায়।
- বিশৃঙ্খল পরিবেশ : সুশৃঙ্খল পরিবেশ সামাজিক মূল্যবােধের বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করে এবং বিশৃঙ্খল পরিবেশ সামাজিক মূল্যবােধের অবক্ষয়ের কারণ বলে বিবেচিত হয়।
- সহনশীলতার অভাব : সহনশীলতার অভাবে সমাজে হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি, দ্বন্দ্ব, সংঘাত ইত্যাদি বৃদ্ধি পায়। বলে সামাজিক মূল্যবােধের অবক্ষয় ডেকে আনে।
- আইনের শাসনের অভাব : সমাজে আইনের শাসনের অভাব হলে সামাজিক মূল্যবােধের অবক্ষয় দেখা দেয়।
সামাজিক বিশৃঙ্খলা বা অসংগতি, নৈরাজ্য এবং সামাজিক মূল্যবােধের অবক্ষয়ের কারণে বাংলাদেশে নানা ধরনের সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে বিরাজমান প্রধান প্রধান সামাজিক সমস্যাগুলাে নিম্নরূপ :
- জনসংখ্যা সমস্যা
- দারিদ্র
- নিরক্ষরতা
- বেকারত্ব
- অপরাধ
- কিশাের অপরাধ
- দুর্নীতি
- পুষ্টিহীনতা
- মাদকাসক্তি
- পতিতাবৃত্তি
- ভিক্ষাবৃত্তি ও ভবঘুরে সমস্যা
- যৌতুক প্রথা ও নারী নির্যাতন
- বিবাহ বিচ্ছেদ
- মানসিক প্রতিবন্ধী সমস্যা
- নিরাপত্তাহীনতা
- সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টনের সমস্যা
- স্বাস্থ্যহীনতা ইত্যাদি।