ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় বহুল আলােচিত, প্রাচীন যুগের সর্বশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ শাসনকাল হচ্ছে সেন রাজাদের শাসন। বাংলায় সেন শাসনের বিশেষ তাৎপর্য হলাে, সেনগণই সর্বপ্রথম বাংলার শাসন ক্ষমতা দখল করে সমগ্র বাংলার ওপর তাদের নিরঙ্কুশ শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।
ক্ষমতা গ্রহণ
পাল বংশের পর বাংলায় সেন বংশের রাজত্ব শুরু হয়। সেনদের আদি নিবাস ছিল দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যে। সেন বংশের প্রতিষ্ঠাতা সামন্ত সেনের পিতা বীর সেন। মূলত কর্ণাটক থেকে গৌড় রাজ্যে এসেছিলেন ভাগ্যান্বেষণে। বাংলা তখন পাল রাজাদের অধীনে। রামপাল, কুমারপাল প্রমুখ রাজাগণের শাসনকাল থেকে পাল সাম্রাজ্যে বিভিন্ন দুর্বলতা দেখা দেয়। ফলে শাসনকার্যের সুবিধার্থে পাল রাজারা বিদেশি কর্মচারীদের বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজে নিয়ােগ করতেন। এভাবে সেন বংশীয় লােকেরা প্রথমে পাল রাজাদের অধীনে উচ্চপদে কাজ করতেন।
আরো পড়ুন : সাম্প্রতিক সাধারণ জ্ঞান ২০২২ থেকে ৫০টি এমসিকিউ
রাজা চতুর্থ গােপালের সময় হেমন্ত সেন স্বয়ং রাজসিংহাসনে বসে রাজ্য পরিচালনা শুরু করেন। এভাবেই একদিন রাজা চতুর্থ গােপালকে অবহিত না করেই তিনি নিজেকে গৌড়ের রাজা হিসেবে ঘােষণা করেন। অতঃপর ১০৯৭ খ্রিষ্টাব্দে হেমন্ত সেনের পুত্র বিজয় সেন পালদের বিতাড়িত করে গৌড়ে সেনদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। মূলত এভাবেই গৌড় তথা বাংলায় সেন সাম্রাজ্যের সূত্রপাত হয়।
একথা সত্য যে, সামন্ত সেন কর্ণাটকে বহু যুদ্ধ-বিগ্রহে অংশগ্রহণ করে খ্যাতি অর্জন করে এ বংশের ভবিষ্যৎ উন্নতির সােপান রচনা করেন। তবে তিনি সেন সাম্রাজ্যের যথার্থ স্থপতি ছিলেন না। সামন্ত সেনের পুত্র হেমন্ত সেনই ছিলেন যথার্থ সেন সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। তিনিই মূলত সেন রাজ্যকে গড়ে তােলেন। আর এ রাজ্যকে পরিপূর্ণতা দেন তার ছেলে বিজয় সেন।
সেন যুগের শাসন ব্যবস্থা
যদিও সেন বংশের রাজত্বকাল দীর্ঘদিন স্থায়িত্ব লাভ করতে পারেনি কিন্তু পাল বংশের অবসানের পর বাংলায় পুনরায় রাজনৈতিক ঐক্য এ বংশের হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয়। সেন রাজাদের পৃষ্ঠপােষকতায় হিন্দু ধর্ম বাংলায় সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। সমাজে ব্রাহ্মণদের প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়। তবে সেন যুগে প্রজা নিপীড়ন ব্যাপক ও প্রবল আকার ধারণ করে। গোড়া হিন্দুধর্মের পুনরুত্থানের ফলে এ সময় বৌদ্ধদের ওপর চরম আঘাত আসে। ফলে বৌদ্ধগণ পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে আশ্রয় নেয়।
আরো পড়ুন : ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস
রাজকর্মচারীরা প্রজাদের কাছ থেকে উপঢৌকন আদায় করত। রাজারা প্রজাদের দুঃখ লাঘবের জন্য কোনােরূপ বিধিসঙ্গত প্রচেষ্টা করেননি। সাধারণ শ্রমিক, ভূমিহীন শ্রমিকরা বেশ দুঃখ কষ্টে দিন কাটাত। সেনযুগে জাত-পাতের বিভেদ প্রবল হয়ে ওঠে। সংহতি ও ঐক্য ধ্বংস হয়। বিভিন্ন জাতের উদ্ভব করে কাউকে উচ্চ বা কাউকে নিচু বলে ঘােষণা করা হয়। এভাবে সেন শাসিত বাংলাদেশে এক প্রকার স্বৈরাচার কায়েম হয়।
পতনের কারণ
শ্রেণি সংঘাত : শ্রেণি সংঘাত ছিল সেন বংশের পতনের অন্যতম কারণ। কৌলীন্য প্রথার ফলে ব্রাহ্মণরা কুলীন গােত্রীয় শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত থাকায় উচ্চ সুযােগ সুবিধা ভােগ করত। ফলে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা দেয়।
প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা : বিজয় সেন ও লক্ষ্মণ সেনের পর সেন বংশে তেমন কোনাে দক্ষ শাসক ছিল না। যার ফলে দেখা দেয় প্রশাসনিক দুর্বলতা ও অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ।
পরধর্মে সহিষ্ণুতার অভাব : বাংলায় পাল রাজাদের পরধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা ছিল কিন্তু সেনদের তা ছিল না। বৌদ্ধদের ওপর এমনভাবে দমন, নিপীড়ন করা হয় যে তারা আশপাশের বিভিন্ন দেশে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
কৌলীন্য প্রথা
কৌলীন্য হলাে ‘হিন্দু কুল ও বর্ণ সমীণ আইন’ বাংলার সমাজ সংস্কারের লক্ষ্যে রাজা বল্লাল সেন কৌলীন্য প্রথা প্রবর্তন করেন। কৌলীন্য বলতে বুঝায় নয়টি গুণের ভিত্তিতে সৃষ্ট একটি কাল্পনিক উচ্চ শ্রেণি যাদেরকে কুলীন বলা হতাে। কুলীন অর্থ উত্তম পরিবার বা সম্রান্ত বংশজাত। নয়টি গুণ : আচার (শুদ্ধতা), বিদ্যা, তপস্যা, আবৃত্তি (সমবর্ণে বিবাহ), নিষ্ঠা, বিনয়, প্রতিষ্ঠা (শুদ্ধতার খ্যাতি), তীর্থদর্শন ও দান (উদারহস্ত)।
প্রাচীনকাল থেকেই বাংলায় ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুন্দ্র এ চার জাত বিদ্যমান ছিল। কৌলীন্য প্রথা প্রথমে ব্রাহ্মণদের মধ্যে প্রচলন করা হলেও কালক্রমে তা অন্যান্য জাতের হিন্দুদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। এ প্রথার ফলে হিন্দুরা নিজ জাতির মধ্যেই পরস্পর আচার-আচরণ ও বৈবাহিক বিষয়ে নানা রকম জটিল রাজনীতি ও নীতির মুখােমুখি হয়।
আরো পড়ুন : ভালাে বক্তা হবেন যেভাবে
সমজাতীয় সমাজে বিভিন্ন বংশকে উচ্চ ও নীচ রূপে চিহ্নিত করা হয়। যা সমাজ ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেয়। কুলীনরা অকুলীনদের কাছ থেকে অন্যায়ভাবে নানা রকম সুবিধা আদায় করত। সমাজে নারীদের অবস্থা হয় শােচনীয়। কুলীনের ছেলে কুলীন ছাড়া অকুলীন মেয়েকেও বিবাহ করতে পারত, কিন্তু কুলীনের মেয়ের বিবাহ কুলীনের ছেলের সাথেই দিতে হতাে নয়তাে, মেয়ের বাপের কৌলীন্য ভঙ্গ হতাে।
সমাজে তাকে হীন মনে করা হতাে। এর ফলে মেয়েদের বিবাহ কখনাে হতাে অত্যন্ত বাল্য বয়সে কখনাে বেশি বয়সে। অল্প বয়সি পুরুষের সাথে বয়সি নারীর বিবাহ হতাে। আবার অনেকে উপযুক্ত পাত্রের অভাবে আজীবন কুমারী থাকতাে। অন্যদিকে, কুলীন পুরুষ অপদার্থ হলেও একাধিক বিবাহ করত।
বিজয় সেন
বিজয় সেন ছােট পরিসরে গড়ে ওঠা সেন রাজ্যকে একটি পরাক্রমশালী সাম্রাজ্যে পরিণত করেন। ১০৯৭-১১৫৮ খ্রিষ্টাব্দ ছিল তার রাজত্বকাল। পাল বংশের শেষ রাজা মদন পালকে তার রাজধানী গৌড় থেকে বিজয় সেনই বিতাড়িত করেন। এতে মদন পাল উত্তরবঙ্গে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। আট বছর পর মদন পালের মৃত্যু হলে বিজয় সেন উত্তরবঙ্গও দখল করে নেন। তিনি রামপালকে বরেন্দ্র পুনরুদ্ধারে সাহায্য করেন এবং এর বিনিময়ে স্বাধীনতার স্বীকৃতি পেয়েছিলেন।
বিজয় সেন বিয়ে করেন শুরবংশীয় রাজকন্যা বিলাসদেবীকে, যেন শক্তিশালী শূর বংশের সাথে সুসম্পর্ক বজায় থাকে। বিজয় সেনের প্রথম রাজধানী ছিল হুগলি জেলার বিজয়পুরে এবং দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপিত হয় বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরে। বিজয় সেনের সভাকবি ছিলেন উমাপতি ধর। ১১৫৮ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন তার ছেলে বল্লাল সেন।
বল্লাল সেন
বল্লাল সেনের জন্ম ১০৮৩ সালে রামপাল নগরে। তিনি ছিলেন সেন রাজ্যের দ্বিতীয় প্রধান রাজা। তিনি ১১৫৮ – ১১৭৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত (২১ বছর) বাংলায় রাজত্ব করেন। তার রাজ্য পূর্বে পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমে মগধ ও উত্তরে দিনাজপুর থেকে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। পাল রাজাদের ওপর চুড়ান্ত আঘাত বল্লাল সেনই আনেন। তিনি ‘কৌলীন্য প্রথা তৈরি করেন। বল্লাল সেন পাঁচটি বই লিখেছিলেন— ‘দানসাগর’, ‘অদ্ভুতসাগর’, ‘ব্রতসাগর’, ‘আচারসাগর’ ও প্রতিষ্ঠাসাগর। এর মধ্যে দানসাগর’ তিনি নিজেই ১১৬৮ খ্রিষ্টাব্দে শেষ করেন।
কিন্তু ‘অদ্ভুতসাগর’ শেষ করতে হয় তার ছেলে লক্ষ্মণ সেনকে। তিনি ঢাকেশ্বরী মন্দির, বিক্রমপুরের বল্লালবাড়ি (বর্তমান মুন্সিগঞ্জ), নির্জরপুর বল্লালবাড়ি (বর্তমান বগুড়া শেরপুর) ও বল্লাল ঢিপি নির্মাণ করেন। বল্লাল সেন জীবনের শেষ সময়টা নির্ভেজাল ও শান্তিপূর্ণভাবে কাটাতে চান। তাই বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর ছেলে লক্ষ্মণ সেনকে রাজ্যভার বুঝিয়ে দিয়ে তিনি স্ত্রী, রমাদেবীকে নিয়ে ত্রিবেণীর কাছে গঙ্গাতীরবর্তী একটি জায়গায় চলে যান এবং সেখানেই বাকি জীবন কাটিয়ে দেন।
লক্ষ্মণ সেন
লক্ষ্মণ সেন ছিলেন সেন বংশের তৃতীয় প্রধান রাজা এবং ইতিহাসের পাতায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তিনি শাসনভার নেন ৬০ বছর বয়সে। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, সেন রাজারা ইতিহাসের সবচেয়ে অত্যাচারী রাজা ছিলেন এবং লক্ষ্মণ সেন তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ। সেনরা গোঁড়া হিন্দু ছিল বিধায় অন্য ধর্মের প্রতি তাদের কোনাে সহমর্মিতা ছিল না।
অনেকের মতে, বল্লাল সেনের কৌলীন্য প্রথার কারণে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা সবসময়ই সেন রাজাদের পতন কামনা করতাে। লক্ষ্মণ সেনের সময় প্রজাদের একটি বিদ্রোহও ঘটেছিল। লক্ষ্মণ সেন অতিবৃদ্ধ হয়ে যাওয়ায় রাজ্য ঠিক মতাে পরিচালনা করতে পারছিলেন না। তাই সবচেয়ে সুরক্ষিত নদীয়ায় চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
আরো পড়ুন : এপ্রিল মাসের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসসমূহ
খলজি সেনার ভয়ে নদীয়ার প্রবেশপথ রাজমহল ও তেলিয়াগড়ের নিরাপত্তা জোরদার করেন। কিন্তু বখতিয়ার খলজি মাত্র ১৭ জন সৈন্য নিয়ে নদীয়ায় প্রবেশ করেন পেছনের ঝাড়খন্ডের শ্বাপদসংকুল বনের মধ্য দিয়ে। এই খবর শুনে নিশ্চিত পরাজয় বুঝে লক্ষ্মণ সেন বিপরীত পথ দিয়ে নৌ পথে বিক্রমপুর পালিয়ে যান।
প্রজারাই যখন মুসলমান শাসকের আনুগত্য মেনে নিয়েছিল, তখন অতিবৃদ্ধ লক্ষ্মণ সেনের এ ছাড়া আর কোনাে উপায় ছিলাে না। তার মৃত্যুর পর প্রথমে মাধব সেন তারপর কেশব সেন বিক্রমপুরকেন্দ্রিক সেন রাজ্যের রাজা হন। কিছুদিন পর এই নামমাত্র শাসনের অবসান ঘটে এবং শুরু হয় মুসলমান শাসকদের রাজত্ব।
বিভিন্ন পরীক্ষায় আসা প্রশ্নাবলি |
প্রশ্ন : পালদের পর কোন বংশ বাংলা শাসন করে? প্রশ্ন : সেন বংশের আদি নিবাস- প্রশ্ন : সেন বংশের প্রথম রাজা— প্রশ্ন : সামন্ত রাজা থেকে স্বাধীন রাজা – প্রশ্ন : বিজয় সেনের প্রথম রাজধানী— প্রশ্ন : কৌলীন্য প্রথা বাংলায় প্রবর্তন করেন- প্রশ্ন : ‘দানসাগর’ ও ‘অদ্ভুতসাগর’ গ্রন্থের রচয়িতা— প্রশ্ন : অসমাপ্ত ‘অদ্ভুতসাগর’ গ্রন্থটি কে সমাপ্ত করেন? প্রশ্ন : সেন রাজাদের ধর্ম ছিল প্রশ্ন : জনশ্রুতি অনুযায়ী বিখ্যাত ‘ঢাকেশ্বরী মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা একজন রাজা। তার নাম কী? প্রশ্ন : বখতিয়ার খলজি সেন বংশের কোন রাজাকে পরাজিত করেন? প্রশ্ন : বাংলায় সেন বংশের (১০৭০-১২৩০ খ্রিষ্টাব্দ) শেষ শাসনকর্তা ছিলেন- প্রশ্ন : বখতিয়ার খলজি বাংলা জয় করেন কোন সালে? প্রশ্ন : বাংলায় মুসলিম আধিপত্য বিস্তারের সূচনা কে করেন? প্রশ্ন : ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী কোন শতাব্দীতে ভারতবর্ষে আসেন? |