মুসলমানদের নবজাগরণের ইতিহাসে সৈয়দ আমীর আলীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। তিনি ছিলেন একজন চিন্তাবিদ, রাজনীতিবিদ ও সমাজসংস্কারক। ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক চেতনা জাগিয়ে তােলা সৈয়দ আমীর আলীর উদ্দেশ্য ছিল। সৈয়দ আমীর আলী ১৮৪৯ সালের ৮ই এপ্রিল তুগলি জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অসাধারণ মেধাশক্তির অধিকারী ছিলেন।
তিনি তুগলি মাদ্রাসা ও কলেজে অধ্যয়ন করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৮৬৭ সালে এম. এ. পাস করেন। ১৮৬৮ সালে তিনি বি. এল. ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি লন্ডনের লিঙ্কনস ইন’ থেকে ১৮৭৩ সালে ব্যারিস্টারি পাস করেন। দেশে ফিরে সৈয়দ আমীর আলী কলকাতা হাইকোর্টে আইন-ব্যবসা শুরু করেন এবং অল্প সময়ের মধ্যে আইনব্যবসায় সুখ্যাতি অর্জন করেন।
তিনি ১৮৭৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফেললা’ হন এবং একই সালে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক পদে যােগদান করেন। ১৮৯০-১৯০৪ সাল পর্যন্ত সৈয়দ আমীর আলী কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি ছিলেন। সৈয়দ আমীর আলী ১৯০৯ সালে লন্ডনে প্রিভি কাউন্সিলের সদস্যপদ লাভ করেন। তিনি মৃত্যু পর্যন্ত এ পদে আসীন ছিলেন। সৈয়দ আমীর আলী ভারতীয়দের মধ্যে সর্বপ্রথম এ সম্মানের অধিকারী হন।
সৈয়দ আমীর আলী একজন সুসাহিত্যিক ও যশস্বী লেখক ছিলেন। তিনি ‘The spirit of Islam, A short History of the Saracens, Life and Teachings of the Prophet’ প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন। এসব রচনার উদ্দেশ্য ছিল পাশ্চাত্য জগতের কাছে ইসলামের মূলনীতি ও ইসলামের বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ প্রচার এবং ইসলামের অতীত গৌরবের কাহিনী তুলে ধরা। বাংলার মুসলমানদের মধ্যে আত্মচেতনা জাগিয়ে তােলাও এসব গ্রন্থ রচনার উদ্দেশ্যে ছিল।
সৈয়দ আমীর আলী, সৈয়দ আহমদ খান ও নওয়াব আবদুল লতিফের মতাে পাশ্চাত্য-শিক্ষা গ্রহণ ও সরকারের সাথে সহযােগিতার নীতিতে আস্থাবান ছিলেন। রাজনীতির ক্ষেত্রে তাঁর নিজস্ব চিন্তাভাবনা ও পরিকল্পনা ছিল। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা জাগিয়ে তুলতে হবে।
তাঁর বিশ্বাস ছিল রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত ভারতীয় তথা বাংলার মুসলমানরা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে তাদের ন্যায্য অধিকার, দাবিদাওয়া আদায় করতে পারবে না। অধিকার আদায়ের জন্য এবং বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য মুসলমানদের নিজস্ব রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়ােজনীয়তা তিনি গভীরভাবে অনুভব করেন।
এ উদ্দেশ্যে সৈয়দ আমীর আলী ১৮৭৭ সালে কলকাতায় সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মােহামেডান এসােসিয়েশন’ (Central National Mohammedan Association) নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। অল্প কয়েকবছরের মধ্যে বাংলা, বিহার, যুক্ত প্রদেশ, পাঞ্জাব, চেন্নাই (মাদ্রাজ), মুম্বাই (বােম্বে) প্রভৃতি স্থানে এ সমিতির ৫০টি শাখা স্থাপিত হয়। সৈয়দ আমীর আলী ভারতীয় মুসলমানদের রাজনৈতিক আন্দোলনের পথপ্রদর্শক ছিলেন।
তাঁর প্রতিষ্ঠিত সমিতি ছিল মুসলমানদের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠান ত্রিশ বছর যাবৎ মুসলমানদের বিভিন্ন দাবিদাওয়া সরকারের কাছে পেশ করে। পরবর্তীতে ১৯০৬ সালে নওয়াব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। সৈয়দ আমীর আলী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠাকে স্বাগত জানান।
১৯০৮ সালে তাঁর নেতৃত্বে মুসলিম লীগের লন্ডন শাখা গঠিত হয়। লন্ডন থেকে তিনি মুসলমানদের স্বতন্ত্র নির্বাচনের দাবির সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। ১৯১২ সালে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি লন্ডনে ব্রিটিশ রেড ক্রিসেন্ট সােসাইটি স্থাপনের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। এই মহান ব্যক্তি ১৯২৮ সালে ইংল্যান্ডে ইন্তেকাল করেন।