আমাদের সকল পোস্ট ও ভিডিও হোয়াটসঅ্যাপে পেতে ফলো করুন :

Click Here
বিসিএস প্রস্তুতিবিসিএস লিখিত আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী

বিংশ শতাব্দীর প্রথম মহামন্দা (Great Depression) কখন শুরু হয় এবং এর পিছনে কি কি কারণ ছিল?

বিংশ শতাব্দীর প্রথম মহামন্দা (Great Depression) কখন শুরু হয় এবং এর পিছনে কি কি কারণ ছিল?

বিংশ শতাব্দীর প্রথম মহামন্দা (Great Depression) দেখা দিয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) পরে। বিশ্ব ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরােপ যখন অর্থনীতি মন্দার দিকে ধাবিত হয় তখন সমগ্র বিশ্ব মন্দার দিকেই ধাবিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রধান কারণ জার্মানদের উগ্র জাতীয়তাবাদ নীতি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির বিপক্ষে অক্ষশক্তি (Axis powers) যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র ৬ এপ্রিল ১৯১৭ সালে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণার মাধ্যমে এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তি ছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স, সার্বিয়া, বেলজিয়াম ও রাশিয়া।

অন্যদিকে জার্মানি, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, তুরস্ক অক্ষশক্তি হিসেবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এ যুদ্ধের ফলেই বিংশ শতাব্দীতে প্রথম মহামন্দা দেখা দেয়। বিংশ শতাব্দীর মহামন্দা (দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন) সমগ্র পৃথিবীর অর্থনীতিতে গভীর অমাবস্যা সৃষ্টি করেছিল। বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা নতুন কোনাে ঘটনা নয়। যুগে যুগে মন্দা-মহামন্দার অভিঘাতে দুর্বিষহ জীবন কাটিয়েছে সমগ্র বিশ্বের মানুষ। মহামন্দা কেটে গিয়ে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে সুবাতাসও প্রবাহিত হয়ে সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে এসেছে মানুষের জীবনে। পুনরায় বিশ্ববাসীকে মুখােমুখি হতে হয়েছে মন্দাগ্রস্ত অর্থনীতির। মন্দা-মহামন্দা বিভিন্ন কারণে ফিরে এসেছে বারবার। ১৮৭৩ সাল থেকে ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত তেমনি এক দীর্ঘ মন্দাকালের কথা জানা যায়। এর সূত্রপাত হয়েছিল ইউরােপ ও আমেরিকায় যার পশ্চাতে ছিল শেয়ারবাজার ধস।

আরো পড়ুন : ৪১তম বিসিএস প্রস্তুতির জন্য সাধারন বিজ্ঞান থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর ১ম পর্ব

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রেট ডিপ্রেশন : দীর্ঘ দুই শতাব্দীর ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরােপের অর্থনীতির চাকা যেদিকে প্রবাহিত হয় বিশ্ব অর্থনীতিও সেদিকে প্রবাহিত হয়। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেও অর্থাৎ ১৯২৯-৩৪ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেট ডিপ্রেশন এর মন্দ সময় হলে তা দীর্ঘ দশ বছর ধরে চলে। কর্মক্ষম ও কর্মেচ্ছ প্রতি চারজনের একজন তখন বেকার। কেইনসীয় অর্থনীতির সমর্থক অধ্যাপক জন কেনেথ গ্যালব্রেথের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে তখন কার্যকর চাহিদা হাসের ফলে উৎপাদন হ্রাস পায় আবার আয়ের অসম বণ্টন ক্ষমতা কুক্ষিগত থাকে কয়েকটি কোম্পানির হাতে, ব্যাংকিং ব্যবস্থার ক্রটি বিশ্বমন্দাকে ঘনীভূত করে।

মনিটারিস্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মিলটন ফ্রিডম্যান মহামন্দার প্রধান কারণ সম্পর্কে মুদ্রার যােগান হ্রাস পাওয়াকে শনাক্ত করেন। মহামন্দার পরিস্থিতি যেমন রুজভেল্টকে হােয়াইট হাউজে আসতে সাহায্য করে একইভাবে মহামন্দার হাত থেকে পরিত্রাণের জন্য অনেকে ফ্যাসিজমকে সমর্থন করায় হিটলার ক্ষমতায় এসেছিলেন। বিশ্বব্যাপী দ্বিতীয় বৃহৎ এ মন্দা অনুভূত হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ১৯২৯ সালে। এটি চলতে থাকে ১৯৩৪ সাল এমনকি চল্লিশের দশক পর্যন্ত। রাষ্ট্র ও অঞ্চলভেদে পার্থক্য ঘটেছে এ মন্দার গভীরতা ও সময়কালের। মহামন্দার সূত্রপাত হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রে-এর পেছনে ছিল শেয়ারবাজার ধস। তাছাড়া ক্রমাগত উচ্চ হারের বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি, ঋণগ্রস্ততা বিনিয়ােগের ক্রমহাস এবং বৈশ্বিক দ্বন্দ্বের কারণে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই এক ভয়াবহ অস্থিরতা বিরাজ করেছিল।

মহামন্দার প্রকৃতি ও কারণসমূহ : বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মহামন্দার পেছনে একক কোনাে কারণ বিদ্যমান নয়। বিংশ শতাব্দীর প্রথম মহামন্দার পেছনে যেসব কারণ বিদ্যমান সেগুলাে নিচে আলােচনা করা হলাে :

পুঁজিবাদ ব্যবস্থা : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলাে পুঁজিবাদ ব্যবস্থার দিকে ঝুকে পড়েছে। সর্বোচ্চ মুনাফার তাড়নায়ই পুঁজিবাদ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। সমগ্র পৃথিবীকে শক্তির দ্বারা নিজ নিজ নিয়ন্ত্রণে আনার প্রাণান্ত চেষ্টা চলে। সাম্রাজ্যবাদের পর্যায়ে উৎপাদনশীল শিল্প-পুঁজির পাশাপাশি ক্রমশ বেশি বেশি গুরুত্ব পেতে শুরু করে লগ্নিপুঁজি। লগ্নি-পুঁজি বিনিয়ােগে সরাসরি উৎপাদন বাড়ায় না, তাই প্রকৃত বিচারে বলা যায় এ পুঁজি অনুৎপাদনশীল। শুরুর দিকে উৎপাদনশীল ভূমিকা ছিল লগ্নিপুঁজির, পরবর্তীতে সে লক্ষ্য ধরে রাখতে পারেনি। ফলশ্রুতিতে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যকে সঙ্কটপূর্ণ করে তােলে। শুরু হয় পুঁজিবাদের স্থবিরতা।

আরো পড়ুন : ৪১তম বিসিএস প্রস্তুতি সাধারন জ্ঞান আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী ৪র্থ পর্ব

বিশ্বজুড়ে মুদ্রাস্ফীতি : বিশ্ব অর্থনৈতিক মহামন্দার অন্যতম একটি কারণ বিশ্বজুড়ে মুদ্রাস্ফীতি। যা রােধে বিশ্বের সরকার প্রধানরা নানাবিধ উদ্যোগ নিলেও ঠেকাতে পারেনি। এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি নাজুক অবস্থায় পড়ে তেলসমৃদ্ধ বিশেষ করে তেল রপ্তানিকারক দেশগুলাে। কারণ এসব দেশে হঠাৎ করে বৈদেশিক মুদ্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় দক্ষতার সঙ্গে মুদ্রা পরিচালনায় তারা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে তেল আমদানিকারক দেশগুলােতে তেল, খাদ্যসহ নিত্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়।

দুর্বল মুদ্রানীতি ও অব্যবস্থাপনা : বিংশ শতাব্দীর প্রথম মহামন্দার অন্যতম প্রধান কারণ অর্থনৈতিক তথা মুদ্রানীতির দুর্বলতা ও অব্যবস্থাপনা। বিশেষজ্ঞরা এর মূলে মুক্তবাজার অর্থনীতিকে অভিযুক্ত করেছে। বিংশ শতাব্দী জ্ঞান-বিজ্ঞানে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করলেও বাজারে অর্থনীতির নীতিগত দুর্বলতা পৃথিবীতে এ রকম মহামন্দা সৃষ্টি করেছে এবং করবে। বিশ্বব্যাপী এ মহামন্দা তারই একটি প্রতিফল।।

উৎপাদন সমস্যা : বিশ্বের অর্থনৈতিক এ মহামন্দার আরেকটি কারণ অধিক উৎপাদন। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে পুঁজিপতিরা তাদের সর্বোচ্চ মুনাফা লুটে নেওয়ার জন্য তাদের অর্জিত মুনাফার বড় একটা অংশ শিল্প উৎপাদনে বিনিয়ােগ করে। তাদের সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের প্রক্রিয়া আবার জনসাধারণের প্রকৃত আয়কে সীমিত করে রাখে। ফলে শিল্প উৎপাদনে পুঁজি খাটিয়ে উৎপাদন বাড়ালেও তার চাহিদা প্রত্যাশিত হারে বড়ে না, সেজন্য বিক্রিও তেমন বাড়ে না। অন্যদিকে গুদামে পণ্যদ্রব্য জমে পাহাড়সম হয়ে পড়ে। তাই শিল্পে বিনিয়ােগ করাটা আর লাভজনক থাকে না অথচ সর্বোচ্চ মুনাফা তাদের চাই, সে লক্ষ্যে পুঁজিও খাটাতে হবে। এভাবে অনুৎপাদনশীল ক্ষেত্রে পুঁজি বিনিয়ােগ এবং অধিক উৎপাদন বিশ্বে অর্থনৈতিক মহামন্দার যৌক্তিক কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ভােগবাদী মার্কিন অর্থনীতি : বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তিধর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুক্তবাজার।অর্থনীতির নামে প্রতিষ্ঠা করেছে ভােগবাদী দেউলিয়া অর্থনীতি। তারা এতটাই ভােগবাদী অর্থনীতি গ্রহণ করেছিল যে সামান্য বিপর্যয় ঠেকাতেও অক্ষম। তাদের অর্থনীতিতে সঞ্চয় প্রবৃত্তি ছিল না বললেই চলে। তাই বিংশ শতাব্দীর প্রথম অর্থনৈতিক মন্দা মহামন্দায় রূপ নেয়। সরকার বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেও এ বিপর্যয়ের হাত থেকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা থেকে রক্ষা করতে পারেনি। মার্কিন মন্দা ধীরে ধীরে বিশ্বব্যাপী সংক্রমিত হয়। কাজেই এ কথা বলা যায় যে মার্কিন অর্থনীতির বিপর্যয়ই বিশ্ব অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণ।

আরো পড়ুন : ১৭তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা প্রস্তুতি আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী ৩য় পর্ব

আর্থিক খাতে রাষ্ট্রপ্রধানদের উদাসীনতা : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের উন্নত দেশসমূহ মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে ব্যাংকিংসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নশীল খাতে সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রায় শূন্যের কোঠায় নিয়ে এসেছে। এর সাথে উন্নত দেশের ব্যাংকসমূহ সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় কোনাে রকমের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা না থাকায়। এ ব্যাংকসমূহ সুপথে-বিপথে বাণিজ্যিক ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করে এবং অর্থনৈতিক বিপদের সম্মুখীন হয়।

শেয়ারবাজার ধস : বিংশ শতাব্দীর প্রথম মহামন্দার পেছনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল শেয়ারবাজার ধস। শেয়ারবাজারের ধসের প্রভাব দ্রুত সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হ্রাস পায় প্রায় ৫০ শতাংশ। শিল্পের উৎপাদন কমে যায় দেশে দেশে। মানুষের ব্যক্তিগত আয়, সরকারের আয়, দ্রব্যমূল্য ও মুনাফা সবই মারাত্মক হ্রাস পায়। আমেরিকাতে বেকারত্বের হার দাঁড়ায় ২৫ শতাংশে। অন্যান্য দেশে তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত। কৃষিপণ্যের মূল্য প্রায় ৬০ ভাগ কমে যাওয়ায় দারুণ আর্থিক সংকটে পড়ে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। উল্লেখ করার মতাে হ্রাস পায় জাতীয় আয়। ১৯৩০ সালে বিশ্বব্যাপী সৃষ্ট মহামন্দাকে ভয়াবহ উল্লেখ করা হয়। কোনাে একটি দেশ এ মন্দার জন্য দায়ী না হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এ মন্দার সূত্রপাত হয়। আর সে মন্দা সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে বিশ্ব অর্থনীতিতে।

উপরিউক্ত আলােচনার আলােকে বলা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিশ্ব মহামন্দা দেখা দিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির সাথে সারা বিশ্বের অর্থনীতি জড়িত। এর বিশেষ কারণ হলাে আন্তর্জাতিক বাজারে কেনাবেচার মাধ্যম হচ্ছে মার্কিন ডলার। মার্কিন ডলারের ক্রয়ক্ষমতা কমার অর্থ হলাে অন্যদেশেরও ক্রয়ক্ষমতা কমা। মার্কিন অর্থনীতিতে মন্দা মানে বিশ্বের অন্যান্য দেশের অর্থনীতিতেও মন্দা সৃষ্টি হওয়া। বিংশ শতাব্দীর প্রথম মহামন্দা সৃষ্টিতে মার্কিন অর্থনীতির মহামন্দা প্রধানত দায়ী। বিশেষ করে পুঁজিবাদী বিশ্বের অতি উদারীকরণ নীতি এ মন্দার পেছনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। এ ছাড়াও এর জন্য দায়ী মুক্তবাজার অর্থনীতি পরিচালনায় ব্যবস্থাপনাগত ক্রটি।

Md. Mahabub Alam

I am a committed educator, blogger and YouTuber and I am striving to achieve extraordinary success in my chosen field. After completing Masters in Anthropology from Jagannath University, I am working as Chief Accounts Officer in a national newspaper of the country. I really want your prayers and love.
Back to top button