মার্কিন গােয়েন্দা সংস্থা CIA-এর গােয়েন্দা প্রতিবেদনের সকল অনুমান ভুল করে ১৫ আগস্ট ২০২১ অবিশ্বাস্য দ্রুততায় আফগানিস্তান দখল করে তালেবান। এর মধ্য দিয়ে দুই দশক পর দেশটিতে আবারও তালেবানের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলামী আদর্শমূল্যবােধ ঠিক রেখে বর্হিবিশ্বের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তােলার জন্য হয়তাে কিছু বাহ্যিক বিষয়ে ছাড় দিবে এবং তা ইতােমধ্যে তারা প্রমাণও করেছে। কিন্তু তালেবানের এ বিজয় তাদের জন্য যতটা গুরুত্বপূর্ণ তার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বর্হিবিশ্বে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব। তালেবানের পূর্বাপর নিয়ে আমাদের প্রচ্ছদ আয়ােজন।
স্বাধীনতা পরবর্তি আফগানিস্তান
দীর্ঘ ব্রিটিশ দখলদারিত্বের পর ৮ আগস্ট ১৯১৯ রাওয়ালপিন্ডি চুক্তির মাধ্যমে আফগানিস্তানকে স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়া হয়। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘােষণা দেয়া হয় ১৯ আগস্ট। ব্রিটিশরা ১৯২১ সালে সম্পূর্ণভাবে আফগানিস্তানের হাতে বৈদেশিক বিষয়গুলাের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেয়। তখন আফগানিস্তানে ক্ষমতায় ছিলেন আমানউল্লাহ খান ।
৮ নভেম্বর ১৯৩৩ মুহাম্মদ জহির শাহ বাদশাহ হিসেবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ১৭ জুলাই ১৯৭৩ তাকে উৎখাত করেন তারই ভগ্নিপতি এবং দেশের প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান জেনারেল মােহাম্মদ দাউদ খান। তিনি আফগানিস্তানকে প্রজাতন্ত্র ঘােষণা করেন বিলুপ্ত হয় রাজতন্ত্র।
২৮ এপ্রিল ১৯৭৮ আকস্মিক এক অভ্যুত্থানে জেনারেল দাউদ খান নিহত হন এবং বামপন্থী সামরিক কর্মকর্তা নুর মােহাম্মদ তারাকির নেতৃত্বে একটি বিপ্লবী পরিষদ ক্ষমতা দখল করে। এরপর তারাকিকে পদচ্যুত করে হাফিজুল্লা আমিনের ক্ষমতা গ্রহণ এবং হাফিজুল্লাকে পদচ্যুত করে বারবাক কারমাল ২৭ ডিসেম্বর ১৯৭৯ ক্ষমতা গ্রহণের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই (২৮ ডিসেম্বর) সােভিয়েত ইউনিয়নের কাছে জরুরি সামরিক সহায়তা চান। সােভিয়েত ইউনিয়নও দ্রুতবেগে এই আহ্বানে সাড়া দেয়।
আফগানিস্তানে সৈন্য প্রবেশের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ৯ বছর দখলদারিত্ব বজায় রাখে। সােভিয়েত ইউনিয়ন। আর ১৫ ফেব্রুয়ারি। ১৯৮৯ আফগানিস্তান থেকে সর্বশেষ সােভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
তালেবানের জন্ম ও উত্থান
আফগানিস্তান থেকে সােভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহারের আগে থেকেই অর্থাৎ, ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৮৭ মুহাম্মদ নজিবুল্লা’র নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়। ১৬ এপ্রিল ১৯৯২ সাত দলীয় মুজাহিদিনদের একটি গ্রুপ তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। এরপরেই আফগানিস্তান জুড়ে শুরু হয় বিশৃঙ্খলা আর নৈরাজ্য।
এ দুরাচার শাসনে অতিষ্ঠ বিভিন্ন গ্রুপ নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়ে। ২৮ এপ্রিল ১৯৯২ শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। সেই যুদ্ধেই তালেবান গােষ্ঠীর উত্থান। তালেবানের আধ্যাত্মিক নেতা মােল্লা ওমর প্রায় অর্ধশত মাদ্রাসার ছাত্র নিয়ে একটি সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তােলেন।
এ দলটিই তালেবান নামে পরিচিত। পশতু ভাষায় ‘তালেব’ অর্থ ‘শিক্ষার্থী’ বা ‘ছাত্র। ১৯৯৪ সালের নভেম্বরে মার্কিন সহায়তায় তালেবান নেতা মােল্লা ওমর কান্দাহার প্রদেশ এবং পরের বছর সেপ্টেম্বরে হেরাত প্রদেশ দখল করে। ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬ তালেবান দেশটির প্রেসিডেন্ট বােরহানউদ্দিন রব্বানির সরকারকে উত্থাত করে রাজধানী কাকুল দখল করে শরীয়াহ আইন প্রতিষ্ঠা করে।
বর্তমান নেতৃত্বে যারা
- হাইবাতুল্লাহ আখুজাদা : তালেবানের রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামরিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী একমাত্র ব্যক্তি।
- মােল্লা মােহাম্মদ ইয়াকুব : তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মােল্লা ওমরের ছেলে। বর্তমানে তালেবানের সামরিক শাখার দায়িত্বে।
- সিরাজুদ্দিন হাক্কানি : তিনি হাক্কানি নেটওয়ার্ক’-এর নেতৃত্ব দেন। এ নেটওয়ার্ক তালেবানের অর্থনৈতিক ও সামরিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। )
- মােল্লা আবদুল গনি বারাদার : তালেবানের অন্যতম সহপ্রতিষ্ঠাতা। তালেবানের রাজনৈতিক শাখার প্রধান বারাদার বর্তমানে দোহায় বেশ কিছু বৈঠকে মধ্যস্থতার কাজ করেন।
ক্ষমতায় আবারও তালেবান
২০০৫ সালের দিকে তালেবানদের আবার পুনরুত্থান ঘটে। দুইদশকের সহিংস লড়াইয়ের পর ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের লক্ষ্যে কাতারের দোহায় যুক্তরাষ্ট্র তালেবানদের সঙ্গে ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর করে।
দুঃশাসনে পিষ্ট আফগানদের জীবনে শান্তি ফেরানাের উদ্দেশ্যে চুক্তিটির নামও দেয়া হয় শান্তি চুক্তি। অনেকেই এ চুক্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের আত্মসমর্পণের দলিল হিসেবে অভিহিত করেন। ১৪ এপ্রিল ২০২১ বাইডেন।
মে-সেপ্টেম্বরের মধ্যে মার্কিন সকলসৈন্য প্রত্যাহারের ঘােষণা দেয়ার পর পূর্ণ শক্তি নিয়ে তালেবান দেশের সর্বত্র হামলা শুরু করে এবং তারই ধারাবাহিকতায় তারা ৬ আগস্ট প্রথম কোনাে প্রাদেশিক রাজধানীর দখল নেয়। আর এ দখলের মাত্র নয় দিনের মধ্যে ১৫ আগস্টে ২০২১ তারা রাজধানী কাবুলসহ ৩৪টি প্রদেশের ২৮টির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রেসিডেন্ট প্যালেস দখল নেয়।
ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব
আফগানিন্তন প্রাচীনকাল থেকেই এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। মধ্যযুগে বিভিন্ন সাম্রাজ্যের সংঘাতের কেন্দ্রস্থল ছিল আফগানিস্তান। ১৫ আগস্ট, ২০২১ আফগানিস্তানে তালেবানের পুনরুত্থান গত ২০ বছরের ভূ-রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তনের ইঙ্গিত লক্ষ্য করা যায়।
চীনের Belt and Rood Initiative (BRI)-এর আওতায় ৬০ বিলিয়ন ডলারের চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডােরের পাশাপাশি ইরানের সাথে চীনের ৪০০ বিলিয়ন ডলারের পারস্পরিক সহযােগিতা চুক্তির সফলতার জন্য যেমন আফগানিস্তানে স্থিতিশীল পরিবেশ থাকা এবং তালেবানের সাথে সুসম্পর্ক রাখা জরুরি, তেমনি মধ্য এশিয়ার দেশগুলােতে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ যাতে ছড়িয়ে না পড়ে তার জন্য রাশিয়ারও এ দেশে তীক্ষ দৃষ্টি রাখা জরুরি।
কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকে যায়, আর সেটা হলাে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে পরাজয় স্বীকার করে নিরবে নিভৃতে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে পলায়ন করেছে কোনাে কারণ ছাড়াই? এখানে অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের কোনাে প্ল্যান বি থাকবে, আর সেটাই স্বাভাবিক। যে দেশটি চীনকে প্রধান শত্রু মনে করে তাদের BRI প্রকল্পের সফলতার পথে।
বাধা সৃষ্টি করতে এবং মধ্য এশিয়া অস্থিতিশীল রেখে রাশিয়াকে ব্যস্ত রাখতে ETIM, IS ও তালেবানকে দিয়েই যে যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতের Great Game এর পরিকল্পনা করছে না, তা প্রত্যক্ষ করার জন্য হয়ত আমাদের আরাে। অপেক্ষা করতে হবে।
সর্বোপরি বলা যায় প্রথমে ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক শক্তি, সােভিয়েত ইউনিয়ন এবং পরে যুক্তরাষ্ট্রের মতাে পরাশক্তির কাছে আফগানিস্তানের মাটি এভাবে এক অদৃশ্য চোরাবালি হয়েই রইলাে।
মার্কিন দখলদারিত্ব ও প্রস্থান
মার্কিন সমর্থিত আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে। তালেবান নেতা মােল্লা ওমরের সুসম্পর্ক ছিল। ওসামা বিন লাদেন যুক্তরাষ্ট্রকে মুসলমানদের শত্রু উল্লেখ করে কয়েকটি দেশে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসে হামলা শুরু করে।
১১ সেপ্টেম্বর ২০০১ আল কায়েদা কর্তৃক কথিত নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে বিমান হামলা চালানাে হয়। তঙ্কালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ। তালেবান নেতা মােল্লা ওমরকে চাপ দেন লাদেনকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেয়ার জন্য কিন্তু ওমর তা প্রত্যাখ্যান করেন।
তিনি ওই হামলা আল কায়েদার নয় বলে দাবি করেন। এরপর পশ্চিমা অন্য দেশগুলােকে সঙ্গে নিয়ে সন্ত্রাসবাদের মূলােৎপাটন করার লক্ষ্যে ৭ অক্টোবর ২০০১ তালেবান ও আল কায়দার স্থাপনা লক্ষ্য করে কাকুল, কান্দাহার ও জালালাবাদে প্রথম বিমান হামলা চালায় মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনী।
১৩ নভেম্বর ২০০১ তালেবান সরকারের পতন হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে ২২ ডিসেম্বর ২০০১ আফগানিস্তানে শুরু হয় হামিদ কারজাইয়ের শাসন। এরপর বিভিন্ন শাসক ক্ষমতায় আসলেও দেশের স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি। ২০০৫ সালের দিকে তালেবানদের আবার উত্থান ঘটে। ওই সময় থেকে তারা আত্মঘাতী হামলা চালানাে শুরু করে।
এ হামলা ঠেকাতে নতুন নতুন পদক্ষেপ নেয় আফগান সরকার এবং গঠন করে আফগানিস্তান ন্যাশনাল আর্মি ও পুলিশ বাহিনী। আফগানিস্তানে অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের মােট ২.২৬ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ হয়। এর মধ্যে শুধু যুদ্ধের পিছনে ব্যয় হয়েছে ৮০০ বিলিয়ন ডলার। পাশাপাশি আফগান সেনাদের প্রশিক্ষণ দিতে খরচ হয়েছে ৮৫ বিলিয়ন ডলার।
প্রতিবছর আফগান সেনাদের বেতন দিতে খরচ হয়েছে ৭৫০ মিলিয়ন ডলার। তালেবান ঠেকাতে এবং আফগান বাহিনীকে শক্তিশালী করতে এত টাকা ব্যয় করেও আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের ২০ বছরের সামরিক মিশনের পতন ঘটেছে মাত্র একদিনেই।
তালেবান যােদ্ধাদের কাকুল দখল, পশ্চিমা সমর্থিত প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির পলায়ন এবং মার্কিন বাহিনীর আফগানিস্তান ত্যাগের মাধ্যমে ১৫ আগস্ট ২০২১ যুক্তরাষ্ট্রের মিশনের অনানুষ্ঠানিক সমাপ্তি হয়।
আফগানিস্তানেও লজ্জা
ভিয়েতনাম যুদ্ধ আর আফগানিস্তান যুদ্ধ, একটা থেকে আরেকটার সময়ের পার্থক্য প্রায় ৪৬ বছর। আফগানিস্তানে তালেবানের বিজয়কে ভিয়েতনামের সায়গনের এ পতনের সাথে তুলনা করা হচ্ছে। + ৩০ এপ্রিল ১৯৭৫ ভিয়েতনামে যে লজ্জায় পড়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, পাঁচ দশক পরে আফগানিস্তানে তারই পুনরাবৃত্তি ঘটল।
১৫ আগস্ট ২০২১ বিনা যুদ্ধে অলেবান বাহিনী কাবুলের প্রেসিডেন্ট প্যালেসের নিয়ন্ত্রণ নেয়। তাদের এই অদম্য অগ্রগতির মুখে দ্রুত কাবুল দূতাবাস খালি করার নির্দেশ দেন। মার্কিন সরকার। পরবর্তী কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দূতাবাসের ছাদ থেকে দফায় দফায় হেলিকপ্টারে উড়াল দেয় মার্কিন বাহিনীর অবশিষ্ট সেনা ও কূটনীতিকরা।