আমাদের সকল পোস্ট ও ভিডিও হোয়াটসঅ্যাপে পেতে ফলো করুন :

Click Here
আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কি আসন্ন?

গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠাতা ও মার্কসবাদী তাত্ত্বিক মাও জেদং তাঁর রাজনৈতিক জীবনে অসংখ্যবার ‘কাগুজে বাঘ’ শব্দবন্ধ উচ্চারণ করেছেন। বিশ শতকের ওই সময়টি ছিল তুমুল উত্তেজনাকার স্নায়ুযুদ্ধের যুগ। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত গণচীনকে রাষ্ট্র হিসেবে মেনেও নেয়নি যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রায় পুরো বিশ্ব। তখন তাইওয়ান ছিল ‘চীন’। কিন্তু বিশ্বের বৃহত্তম জনসংখ্যার কমিউনস্ট-শাসিত রাষ্ট্রটির অস্তিত্ব অস্বীকার করা তো সম্ভব ছিল না। তাই পশ্চিমাদের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি কথার লড়াইয়ে জিততে মাও জেদং বেছে নিয়েছিলেন ‘কাগুজে বাঘ’ শব্দবন্ধ। তিনি এর ব্যাখ্যায় বলতেন, “বুর্জোয়ারা যত গর্জে তত বর্ষে না।”

স্নায়ুযুদ্ধ ও এর পরবর্তী বিশ্ব

স্নায়ুযুদ্ধের পুরো সময়টায় এটাই ছিল বাস্তবতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই যুক্তরাষ্ট্র ও তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ঠাণ্ডা লড়াই শুরু হয়ে যায়। কখনও কথার লড়াই ও নিজস্ব স্টাইলে প্রচারণা— কখনও-বা আস্ফালন ও হুমকি। আর বেশিরভাগ সময় বিশ্বের নানা প্রান্তে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির প্রয়োগে প্রভাব বিস্তার। কিন্তু কোথাও কখনও পরস্পরের মুখোমুখি হওয়ার ন্যূনতম চেষ্টাও তারা করেনি। কারণ দেশ দুটির মধ্যে একটি বিষয়ে মিল ছিল।

আর তা হলো— পারমাণবিক শক্তির মালিকানা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলা চালানোর ফলে বিশ্ববাসী জেনে গিয়েছিল এর ভয়াবহতার কথা। আর তাই সে পথে কোনো রাষ্ট্রই হাঁটতে চায়নি।
তবে আয়তনে ও সামরিক শক্তিতে বিশ্বের বৃহত্তম দুই রাষ্ট্রের দ্বন্দ্বে তাদের মিত্র রাষ্ট্রগুলোর কূটনৈতিক অবস্থান ও অভ্যন্তরীন রাজনীতি দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বিশ শতকে বিশ্বে নতুন জাতি-রাষ্ট্রগুলোর অভ্যুদয়ের ফলে স্নায়ুযুদ্ধের বিষয়টি অনেক দেশের জন্যই পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছিল। এসব দেশের বেশিরভাগই গ্লোবাল দক্ষিণভুক্ত ও উন্নয়নশীল। ফলে এগুলোর নবপ্রজন্মের শিক্ষিত তরুণদের চাপ, বিকাশমান বৈশ্বিক বাজার ও প্রযুক্তিভিত্তিক সভ্যতার বিপুল বিস্তার পরিস্থিতির অনিবার্য পরিবর্তনের দিকেই বিশ্বকে ধাবিত করে। ফলে আশি ও নব্বই দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙে টুকরো হয়ে যাওয়ার পর ইউরেপের রাজনীতিতে বিরাট পরিবর্তন ঘটে। পশ্চিমা জগতের এই নয়া মেরুকরণ পৃথিবীকে অন্য এক বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করায়।

এককেন্দ্রিক না বহুকেন্দ্রিক বিশ্ব

দুই পরাশক্তির ঠাণ্ডা লড়াইয়ের অবসানে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে আপাত শান্তি বজায় থাকলেও সেটা খুব স্থায়ী হয়নি। এর কারণ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে এককেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার উদ্ভব নিয়ে আশঙ্কা। বিশেষত ইরাক যুদ্ধের প্রেক্ষিতে এই বিষয়টি অনেক দেশের জন্যই মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠে। ফলে নতুন সহস্রাব্দের বেশিরভাগ সময়জুড়ে বিশ্ব এক অস্থিতিশীল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

পুরোনো শক্তিগুলোর মধ্যে নতুন করে জোটবদ্ধতার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। নিজেদের বলয় ভেঙে নতুন বলয়ে প্রবেশ করছে অনেক দেশ। ফলে আরও অসংখ্য মেরুকরণ তৈরি হচ্ছে। এই বাস্তবতায় ২০২৪ সালে বিশ্ব প্রবেশ করেছে নতুন এক যুদ্ধের আশঙ্কা নিয়ে। নানা প্রাঙ্গণে খণ্ড খণ্ডভাবে গড়ে ওঠা রণাঙ্গনগুলো এক অনিশ্চিত বাস্তবতা তৈরি করছে। তবে কি নতুন আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি আমরা?

বর্তমান বিশ্বের প্রধান কয়েকটি যুদ্ধ বা যুদ্ধাবস্থার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে প্রায় সব শক্তিশালী রাষ্ট্র। আর এ কারণেই প্রশ্নটি জোরালো হয়ে উঠেছে। গাজা যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বিস্তার পাওয়া সংঘাত এখন পশ্চিমাদের অ্যাজেন্ডার শীর্ষে রয়েছে। এছাড়া আরও অনেক সমস্যা রয়েছে, যেটা বৈশ্বিক সংবাদের শিরোনাম হয় না। সুদানের গৃহযুদ্ধ, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোয় বাড়তে থাকা সংঘাত, ইথিওপিয়া ও সোমালিয়ার মধ্যকার উত্তেজনা— এ সবকিছুই পশ্চিমা দেশগুলোর জনসাধারণের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করছে।

এর কারণ অভিবাসীর নতুন ঢেউ শুরু হওয়ার ভীতি। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রের মহড়া, ইরানের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত মধ্যপ্রাচ্যের প্রক্সি যোদ্ধা গোষ্ঠীদের কর্মকাণ্ডও পশ্চিমাদের আশঙ্কার কারণ। আর উত্তর কোরিয়া, ইরান ও রাশিয়ার মধ্যে যে বলয় তৈরি হয়েছে, তা বিশ্বজুড়ে বিতর্ক বাড়িয়ে তুলছে।

ফিলিস্তিন ও অস্থির মধ্যপ্রাচ্য

গাজা যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্য কোনো জায়গায় যে অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে পড়ছে, সেটা ইউক্রেন থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ সরিয়ে নিচ্ছে। এককভাবে গাজা যুক্তরাষ্ট্রের পুরোটা মনোযোগ পাচ্ছে। গাজায় ইসরায়েলের হামলার উত্তাপ গিয়ে পৌঁছেছে লোহিত সাগরে।

২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে হুতি বিদ্রোহীরা বাব-আল-মানদিব প্রণালি দিয়ে ইসরায়েল ও পশ্চিমা জাহাজ চলাচল আটকানোর লক্ষ্যে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া শুরু করে। ফলে যে আতঙ্ক তৈরি হয়, তার ফলে শিপিং কোম্পানিগুলো রুট পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। এতে বাড়ছে জ্বালানি থেকে বিমা পর্যন্ত বিভিন্ন রকম খরচ। উল্লেখ্য, বৈশ্বিক জাহাজ চলাচলের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এই প্রণালি দিয়ে হয়।

ক্রমবর্ধমান এই আঞ্চলিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে জর্ডান, ইরান, ইসরায়েল, সিরিয়া, পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইরাক, লেবাননের মতো দেশ। এছাড়া রয়েছে ইয়েমেনে ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠী এবং হামাস, হিজবুল্লাহ, হুতি ও আইএসআই-এর মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। এগুলো মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের যুদ্ধ ছড়িয়ে দেবে নাকি কেবল ছায়া যুদ্ধ হয়ে থাকবে তা নিয়ে তৈরি হয়েছে শঙ্কা।

নতুন রূপে সৌদি আরব

সৌদি আরবে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান শক্তিশালী হয়ে ওঠার পর থেকে দেশটির ভেতরে ও বাইরে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। ২০২৩ সালের মার্চে চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি-ইরান সম্পর্ক নতুন যুগে প্রবেশ করে। কূটনৈতিক সম্পর্ক নতুন করে প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি নিরাপত্তা, বাণিজ্য, অর্থনৈতিক এবং বিনিয়োগ চুক্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার আগে তারা ইসরায়েলের সঙ্গেও সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়া চালাচ্ছিল। কিন্তু গাজায় হামলার পর তারা যুক্তরাষ্ট্রকে ত্রিপক্ষীয় এই সমঝোতা প্রক্রিয়া বাতিল করতে বলে। ২০১৯ সালে সৌদি আরবের আরামকো তেলক্ষেত্রে ব্যাপক হামলা হয়। হুতিরা ঐ হামলার দায় স্বীকার করেছিল। তাতে তাৎক্ষণিকভাবে সৌদির তেল উৎপাদন অর্ধেকে নেমে যায়।

এরপর থেকে আঞ্চলিক ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা শুরু করে তারা। হুতিদের নেপথ্য শক্তি ইরান বলে সৌদি আরব তাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে। গত বছর চীনের মধ্যস্থতায় ঐ যোগাযোগ শুরুর পর তা এখনো অব্যাহত আছে। ফলে হুতিরা সৌদি আরবকে লক্ষ্য করে আক্রমণ বন্ধ রেখেছে। রাজতন্ত্রশাসিত দেশটির এই মুহূর্তে প্রধান লক্ষ্য নিজেকে রক্ষা করা।

মিয়ানমারে যা চলছে

১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের তিন বছর পূর্তি হয়। এর মধ্যে গত তিন মাস তাদের জন্য ছিল স্পষ্ট পিছু হটার সময়। দেশটির ৬০-৭০ ভাগ এলাকায় সংঘাত ছড়িয়েছে। মিয়ানমারকে ঘিরে চীনের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ এবং বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি। একইসঙ্গে এতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইন্দোপ্যাসিফিক পলিসির মাধ্যমে চীনকে ঠেকানোর যে কৌশল, সেটি মোকাবিলা সহজ হবে।

অন্যদিকে, রাখাইন রাজ্য ভারতের জন্য ভূকৌশলগত স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। তাই মিয়ামারের সাম্প্রতিক সংঘাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে উঠেছে এটিই যে, সেখানে নতুন শরণার্থী তৈরি হবে কি না। সন্দেহ নেই যে সেটি ঘটবে। ভারত ও থাইল্যান্ডে ইতোমধ্যে অনেক শরণার্থী ঢুকেছে। বাংলাদেশ লাখ লাখ রোহিঙ্গার ভারে ক্লান্ত হলেও নতুন শরণার্থী আসা নিয়ে নিশ্চয়ই উদ্বিগ্ন। এই আশঙ্কার বিষয়টি বাস্তব।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দুই বছর

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নির্দেশে ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযান শুরুর পর গত দুই বছরে ইউক্রেনে মৃত্যু ও ধ্বংসযজ্ঞ বয়ে গিয়েছে। নিঃসন্দেহে রুশ সামরিক বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতিও কম হয়নি ৷

যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইউক্রেন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি অপরিবর্তিত রয়েছে। গত দুই বছর ধরে ইউক্রেনের মিত্ররা প্রচুর পরিমাণ সামরিক, আর্থিক ও মানবিক সাহায্য দিয়ে আসছে। কিয়েল ইনস্টিটিউট ফর দ্য ওয়ার্ল্ড ইকোনমির হিসাবে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ৯২ বিলিয়ন ডলার এসেছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে, আর ৭৩ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। পশ্চিমাদের সরবরাহ করা ট্যাঙ্ক, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং দূরপাল্লার আর্টিলারি ইউক্রেনকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে ব্যাপকভাবে সাহায্য করেছে।

কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সহায়তার পরিমাণ অনেক কমে গিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ৬০ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা প্যাকেজ ঘরোয়া রাজনীতির মারপ্যাঁচে পড়ে কংগ্রেসে আটকে আছে। আর ইউক্রেনের সমর্থকদের মধ্যে শঙ্কা ভর করেছে যে যদি নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও জিতে আসেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা থমকে যাবে। এদিকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ফেব্রুয়ারিতে নানা আলোচনা ও হাঙ্গেরির সঙ্গে দর কষাকষির পর ৫৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সহায়তার অনুমোদন দিয়েছে।

ইউক্রেনীয়দের পরাজয় শীতল যুদ্ধের দুই শিবিরের মধ্যকার সংঘাতের প্রত্যাবর্তন হতে পারে। কিন্তু এবার সম্ভবত চীনের নেতৃত্বাধীন রাশিয়া, ইরান ও উত্তর কোরিয়ার শক্তিশালী শিবিরের সঙ্গে দুর্বল ও কম ঐক্যবদ্ধ পশ্চিমা জোটের সংঘাত ফিরে আসবে। এতে জলবায়ু পরিবর্তন ও খাদ্য নিরাপত্তার মতো জটিল সমস্যার বিষয়ে রাষ্ট্রগুলো মনোযোগ দিতে পারবে না তাদের বরং ব্যস্ত হয়ে পড়তে হবে আঞ্চলিক সংঘাতের ঢেউ সামলানো এবং ছায়া যুদ্ধের প্রত্যক্ষ প্রভাব থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার মতো বিষয়ে।

Md. Mahabub Alam

I am a committed educator, blogger and YouTuber and I am striving to achieve extraordinary success in my chosen field. After completing Masters in Anthropology from Jagannath University, I am working as Chief Accounts Officer in a national newspaper of the country. I really want your prayers and love.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button