আগের সাহিত্যবিষয়ক আলােচনায় লােকসাহিত্য ও ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ নিয়ে আলােচনা করা হয়েছে। এবার থাকছে নাথসাহিত্য নিয়ে আলােচনা।
নাথ সাহিত্য
নাথসাহিত্য হলাে নাথধর্মের কাহিনি। এগুলাে গীতিকা বা ব্যালাড হিসেবে প্রচলিত। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের শেষভাগে আঠারাে শতকে বেশ কিছু নাথসাহিত্য রচিত হয়; যদিও নাথধর্মের জন্ম খ্রিষ্টীয় নয় থেকে দশ শতকে। পাল আমলের শেষ এবং সেন আমলের শুরুতে নাথধর্মের সূচনা হয়। বৌদ্ধধর্ম ও শৈবধর্মের সমন্বয়ে নাথধর্ম সৃষ্টি হয়েছে।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, নাথপন্থা বৌদ্ধ মহাযান থেকে এসেছে। নাথধর্মের আদিগুরু শিব। নাথধর্মের মূল কথা হলাে সাধনার পথে নারীসঙ্গ অন্তরায়। অথচ চর্যাপদে ঠিক বিপরীত কথা রয়েছে। নাথসাহিত্যে শিব, পার্বতী, মীননাথ, গােরক্ষনাথ, হাড়িপা, কানুপা, ময়নামতী ও গােপীচন্দ্রের কাহিনি স্থান পেয়েছে।
নাথ ধর্মের মূল কাহিনি
শিবের প্রধান শিষ্য চারজন। তাঁরা হলেন হাড়িপা, কানুপা, মীননাথ ও গােরক্ষনাথ। এই চারজনের মধ্যেও সম্পর্ক রয়েছে—হাড়িপার শিষ্য কানুপা আর মীননাথের শিষ্য গােরক্ষনাথ। মীননাথ বা মৎস্যেন্দ্রনাথকে নাথধর্মের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, মীননাথ খ্রিষ্টীয় সাত শতকের সিদ্ধা। এই চারজন সিদ্ধার জীবনের অলৌকিক কাহিনি অবলম্বনে নাথসাহিত্যের বিকাশ ঘটেছে।
নাথ সাহিত্যের কাহিনি দুই ভাগে বিভক্ত
- একটি কাহিনিতে আছে গােরক্ষনাথ কেমন করে মীননাথকে নারীমােহ থেকে মুক্ত করলেন এবং
- অপর কাহিনি রানি ময়নামতী এবং তাঁর পুত্র গােপীচন্দ্রের।
প্রথম কাহিনি ‘গােরক্ষবিজয়’ নামে পরিচিত এবং দ্বিতীয় কাহিনি ‘ময়নামতীর গান’ বা ‘গােপীচন্দ্রের গান’ নামে পরিচিত। প্রথম কাহিনিতে ধর্মীয় মতবাদ প্রতিষ্ঠা প্রাধান্য পেয়েছে। দ্বিতীয় কাহিনি অনেক বেশি জীবনঘনিষ্ঠ।
গােরক্ষবিজয়ের কাহিনি
চারজন শিষ্য কতটুকু দীক্ষা লাভ করেছেন, তা যাচাই করতে চাইলেন শিবের স্ত্রী পার্বতী। শিব তখন ধ্যানযােগে সিদ্ধাদের বাড়িতে ডেকে আনেন। পার্বতী মােহিনীরূপে চার শিষ্যের সামনে আসেন অন্ন পরিবেশন করতে। একে একে হাড়িপা, কানুপা ও মীননাথ কামনাসক্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু গােরক্ষনাথ আগেও গুরুপত্নীকে মায়ের মতাে দেখতেন; এখনাে সেই চোখে দেখতে লাগলেন। ধর্মের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হওয়ার কারণে দেবী তখন অভিশাপ দিলেন তিন সিদ্ধাকে। দেবীর অভিশাপে মীননাথ কদলীরাজ্যে চলে যান। হাড়িপা চলে যান ময়নামতীর পুরীতে।
কানুপা ডাহুকের বেশে উড়ে গেলেন। গােরক্ষনাথকে দেবী নানা কঠিন পরীক্ষায় ফেলেও আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারলেন না। কদলীরাজ্য হলাে নারীরাজ্য—যেখানে নারীসঙ্গে দিন কাটাতে থাকে মীননাথ। গােরক্ষনাথ সেখানে গিয়ে মীননাথকে আবার সুপথে ফিরিয়ে আনেন। কদলীরাজ্যের রমণীরা মীননাথকে ছাড়তে রাজি হননি; তাঁরা গােরক্ষনাথকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন। গােরক্ষনাথ শাপ দিয়ে তাঁদের বাদুড় বানিয়ে দেন। এরপর গুরুকে নিয়ে ফিরে আসেন। এই মীননাথ ও গােরক্ষনাথ—দুজনেই ঐতিহাসিক ব্যক্তি। খ্রিষ্টীয় দশ থেকে এগারাে শতকের মানুষ তাঁরা।
ময়নামতীর গান বা গােপীচন্দ্রের কাহিনি
ত্রিপুরার রাজা মানিকচন্দ্র। তাঁর স্ত্রীর নাম ময়নামতী। ময়নামতী হলেন গােরক্ষনাথের শিষ্যা। স্বামীর মৃত্যুর পরও অলৌকিক শক্তিবলে তিনি পুত্রসন্তানের জননী হতে পেরেছিলেন। তিনি ছেলের নাম রাখেন গােপীচন্দ্র। দুই রাজকুমারীর সঙ্গে ময়নামতী বিয়ে দিলেন ছেলেকে। একজনের নাম অদুনা, আরেকজনের নাম পদুনা।
গােপীচন্দ্র দুই স্ত্রী নিয়ে ভােগবিলাসে দিন কাটাতে লাগলেন। ময়নামতী ছেলেকে বললেন, হাড়িপার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে সন্ন্যাসী হতে হবে। কিন্তু গােপীচন্দ্র কিংবা তার দুই স্ত্রীর কেউই রাজি হলেন না। এমনকি ময়নামতীর সতীত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলল অদুনা ও পদুনা। ময়নামতী সতীত্বের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। পরে অবশ্য গােপীচন্দ্র রাজি হন হাড়িপার শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে। সন্ন্যাসজীবন পালন করে গােপীচন্দ্র ঘরে ফিরে আসেন এবং দুই স্ত্রী নিয়ে সুখে দিন কাটাতে থাকেন।
নাথসাহিত্যের পুঁথি
জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসন (১৮৫১-১৯৪১) রংপুরের কৃষকদের কাছ থেকে নাথসাহিত্যের কাহিনি সংগ্রহ করেন। তিনি ১৮৭৮ এগুলাে মানিকচন্দ্র রাজার গান’ নামে এশিয়াটিক সােসাইটি পত্রিকায় প্রকাশ করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি উত্তরবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জায়গা থেকে একই কাহিনিভিত্তিক আরও পুঁথি সংগ্রহ করেন। এগুলাে ‘মানিক রাজার গান’, ‘ময়নামতীর গান’, ‘গােবিন্দচন্দ্রের গান’, ‘গােবিন্দ্রচন্দ্রের গীত, ‘গােপীচাদের সন্ন্যাস’, ‘গােপীচাঁদের পাঁচালী’ ইত্যাদি নামে প্রচলিত ছিল।
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ গােরক্ষনাথ-মীননাথের কাহিনিভিত্তিক আটটি পুঁথি আবিষ্কার করেন। এ ছাড়া আলী আহমদ সাতটি, নলিনীকান্ত ভট্টশালী একটি এবং পঞ্চানন মণ্ডল একটি নাথসাহিত্যের পুঁথি আবিষ্কার করেন। এসব পুঁথির অধিকাংশই খণ্ডিত। এর মধ্যে তিনটি সম্পাদিত হয়ে প্রকাশিত হয়।
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ সম্পাদিত গ্রন্থের নাম ‘গােরক্ষবিজয়’, নলিনীকান্ত ভট্টশালী সম্পাদিত গ্রন্থের নাম ‘মীনচেতন’ এবং পঞ্চানন মণ্ডল সম্পাদিত গ্রন্থের নাম ‘গাের্থবিজয়। ‘গােরক্ষবিজয়’ কাব্যের রচনাকাল নিয়ে পণ্ডিতমহলে বিতর্ক আছে। শেখ ফয়জুল্লা ছাড়া কবীন্দ্র, ভীমসেন ও শ্যামদাসের নাম ভণিতায় পাওয়া যায়। তবে ভণিতায় নামের সংখ্যাধিক্যের কারণে ফয়জুল্লাকেই ‘গােরক্ষবিজয়’-এর কবি মনে করা হয়। আর অন্যদের ধরা হয় গায়ক।
প্রাপ্ত পুঁথির ভিত্তিতে ময়নামতী-গােপীচন্দ্রের গানের তিনজন কবির সন্ধান পাওয়া যায়। তাঁরা হলেন দুর্লভ মল্লিক, ভবানী দাস ও শুকুর মহম্মদ। দুর্লভ মল্লিকের কাব্যের নাম ‘গােবিন্দ্রচন্দ্রের গীত’; এটি সম্পাদনা করেন শিবচন্দ্র শীল। নলিনীকান্ত ভট্টশালীর সম্পাদনায় ভবানী দাসের ‘ময়নামতীর গান’ এবং শুকুর মহম্মদের ‘গােপীচন্দ্রে সন্ন্যাস’ কাব্য দুটি ঢাকা সাহিত্য পরিষৎ থেকে প্রকাশিত হয়।
শেখ ফয়জুল্লা
শেখ ফয়জুল্লা মুসলমান হয়েও নাথসাহিত্য রচনা করেন। তাঁর রচিত কাব্যের নাম ‘গােরক্ষবিজয়। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ শেখ ফয়জুল্লার ‘গােরক্ষবিজয়’ কাব্যের পুঁথি আবিষ্কার করেন এবং ১৯১৭ সালে প্রকাশ করেন। শেখ ফয়জুল্লা রচিত আরও চারটি পুঁথি পাওয়া গেছে। সেগুলাে হলাে ‘গাজীবিজয়’, ‘সত্যপীর’, ‘জয়নালের চৌতিশা ও ‘রাগনামা’। ১৫৭০ সালের দিকে রচিত গাজীবিজয়’ একটি ঐতিহাসিক কাহিনিকাব্য। জয়নালের চৌতিশা’ একটি মর্সিয়াকাব্য এবং ‘রাগনামা’ সংগীতবিষয়ক বই।
শ্যামদাস সেন
শ্যামদাস সেনের লেখা নাথসাহিত্য ‘মীনচেতন। নলিনীকান্ত ভট্টশালীর সম্পাদনায় ‘মীনচেতন’ প্রকাশিত হয় ১৯১৫ সালে। ভীম সেন ভীম সেন লিখেছেন ‘গাের্থবিজয়’। গাের্থবিজয়’ কাব্য সম্পাদনা করে পঞ্চানন মণ্ডল প্রকাশ করেন ১৯৪১ সালে।
দুর্লভ মল্লিক
দুর্লভ মল্লিক সতেরাে কিংবা আঠারাে শতকের কবি। তাঁর লেখা ‘গােবিন্দচন্দ্রের গীত’ নামক কাব্যটিকে দ্বিতীয় ধারার নাথসাহিত্যের সবচেয়ে পুরােনাে নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করেছেন সুকুমার সেন।
ভবানী দাস
ভবানী দাস ত্রিপুরা অঞ্চলের কবি। তাঁর লেখা ‘ময়নামতীর গান’ নলিনীকান্ত ভট্টশালী ও বৈকুণ্ঠনাথ দত্তের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। অবশ্য মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন, ‘ময়নামতীর গান’ হিন্দু কবি ভবানী দাসের রচনা নয়। এটি অবশ্যই কোনাে মুসলমান কবির লেখা।
শুকুর মহম্মদ
শুকুর মহম্মদের বাড়ি ত্রিপুরা এবং তাঁর জীবনকাল আনুমানিক ১৬৮৩ থেকে ১৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ। শুকুর মহম্মদের কাব্যের নাম ‘গােপীচাঁদের সন্ন্যাস। আঠারাে শতকের শুরুর দিকে কবি এ কাব্য রচনা করেন। নলিনীকান্ত ভট্টশালী দিনাজপুর থেকে কাব্যটি খুঁজে পান এবং সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন। নাথসাহিত্য সম্পর্কে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। নেপালে পাওয়া গিয়েছে নেপালি গদ্যে রচিত ‘গােপীচন্দ্র নাটক।
গােপীচন্দ্র নাটক’-এর রচনাকাল ১৬২০ থেকে ১৬৫৭ সালের মধ্যে। এটি নেপালি ভাষায় রচিত হলেও এর গানগুলাে বিশুদ্ধ বাংলা ভাষায় লেখা। নাথধর্ম ও দর্শনসংক্রান্ত আখ্যানকাব্য ও ছড়াপাচালি যেমন রচিত হয়েছিল, তেমনি আবার বিশুদ্ধ তত্ত্বদর্শন-সংক্রান্ত কিছু ছড়া-কবিতাও পাওয়া গিয়েছে। এসব ছড়া-কবিতায় কোনাে কাহিনি নেই। শুধু সাধন-ভজনের গূঢ় ইঙ্গিতে পূর্ণ পদ বা বিচ্ছিন্ন পক্তি এগুলাে।
পঞ্চানন মণ্ডল ‘গােখবিজয়’ কাব্যের পরিশিষ্টে এ রকম নাথধর্মের সাধন-ভজনকেন্দ্রিক কিছু ছড়া মুদ্রিত করেছেন। পঞ্চানন মণ্ডল এ ধরনের চারটি পুঁথি পেয়েছেন—যােগীর গান’, ‘যুগীকাচ’, ‘গােখসংহিতা’ ও ‘যােগ-চিন্তামণি’। কাহ্নপা ও জালন্ধরীপার রচনা হিসেবে কিছু দোহার সন্ধান। মিলেছে এবং সেগুলাে চর্যাগীতিকার দোহা সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। গােরক্ষপন্থীদের মধ্যে ‘গােরক্ষনির্দেশিকা’ হিসেবে যা প্রচলিত, তা মূলত তিনির্ভর সংকলন। তা ছাড়া মীননাথ কিংবা গােরক্ষনাথের ব্যক্তিগত কোনাে রচনা নেই।
মডেল টেস্টে অংশগ্রহণ করুন
Results
Congratulations
You Failed. Try Again.